পৃথিবী সৃষ্টির পেছনে যেমন ইতিহাস রয়েছে, এর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এলাকা সৃষ্টির পেছনেও তেমনি ইতিহাস আছে। বরগুনা জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে সমুদ্রের কোল ঘেষে সুগন্ধা, পায়রা ও হরিণঘাটা নদীর মোহনায় জেগে ওঠা ভূখণ্ড। এ জেলার সমগ্র ভূখণ্ড একদিন ছিল সুন্দরবন এলাকা। কালের বিবর্তনে মানুষ ক্রমে ক্রমে নানা প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সুন্দরবন কেটে আবাদ শুরু করে জনপদ তৈরী করতে থাকে। তারই ফলে ১৯৩৯.৩৯ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে নয় লক্ষাধিক অধিবাসী অধ্যুষিত ছয়টি উপজেলার সমন্বয়ে আজকের বরগুনা জেলা।
বরগুনা নামের ইতিহাসের সুনির্দিষ্ট কোন তথ্য না পাওয়া গেলেও জানা যায় যে, উত্তরাঞ্চলের কাঠ ব্যবসায়ীরা এতদ্ঞ্চলে কাঠ নিতে এসে খরস্রোতা খাকদোন নদী অতিক্রম করতে গিয়ে অনুকুল প্রবাহ বা বড় গোনের জন্য এখানে অপেক্ষা করত বলে এ স্থানের নাম বড় গোনা। কারো মতে আবার স্রোতের বিপরীতে গুন (দরি) টেনে নৌকা অতিক্রম করতে হতো বলে এ স্থানের নাম বরগুনা। কেউ কেউ বলেন, বরগুনা নামক কোনো প্রতাপশালী রাখাইন অধিবাসীর নামানুসারে বরগুনা। আবার কারো মতে বরগুনা নামক কোনো এক বাওয়ালীর নামানুসারে এ স্থানের নামকরণ করা হয় বরগুনা।
তৎকালিন বৃটিশ আমলে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য ১৮৭১ সনে পটুয়াখালী মহকুমা সৃষ্টি হয়। তখন এ মহকুমায় পটুয়াখালী, মির্জাগঞ্জ, গুলিশাখালী, বাউফল ও গলাচিপাসহ মোট ৫টি থানা ছিল । বামনা ও পাথরঘাটা ছিল মঠবাড়ীয়া থানাধীন। এ সময় বরগুনা গুলিসাখালী থানাধীন ছিল। পরবর্তীতে উক্ত শতাব্দীর শেষ দিকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বামনা, পাথরঘাটা, বরগুনা, বেতাগী ও খেপুপাড়া থানার সৃষ্টি হয়। থানা হিসাবে নামকরণের মাধ্যমে বাংলাদেশের মানচিত্রে বরগুনার নাম স্থান পায়। চতুর্দশ শতাব্দীতে সমগ্র দক্ষিণাঞ্চল ছিল বাকেরগঞ্জের অধীন। আঠারো শতকের মধ্যভাগে পূর্ব বাংলার আলোচিত ব্যক্তি ছিলেন আগাবাকের খান। তাঁর জমিদারী ছিল বাকলা চন্দ্রদ্বীপে। পটুয়াখালী ও বরিশালকে বলা হতো বাকলা চন্দ্রদ্বীপ। শাসনকার্য পরিচালনার জন্য বৃটিশ সরকার ১৭৯৭ সনে ৭ নং রেজুলেশন অনুসারে আগাবাকের খানের নামনুসারে বাকেরগঞ্জ জেলার সৃষ্টি করেন।
শান্তি শৃংখলা রক্ষার জন্য এবং জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য উনিশ শতকের প্রথম দিকে বিশখালী নদীর তীরে ফুলঝুড়িতে একটা অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে ১৯০৪ সালে বরগুনাতে স্থায়ীভাবে ১টি পুলিশ স্টেশন স্থাপন করা হয় ও গুলিশাখালী থানাকে আমতলী ও বরগুনা নামে দুটি পৃথক থানা করা হয়। পরবর্তীকালে বঙ্গোপসাগরে চর পড়তে থাকে এবং সুন্দরবন অঞ্চল আবাদ হয়ে বিরাট জনপদের সৃষ্টি হয় । এভাবে বরগুনা থানার পরিধিও বিস্তার লাভ করে ।
এক কালের সুন্দর বনাঞ্চলের বরগুনা ক্রমান্বয়ে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে পরিণত হয়। এ এলাকাতে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক তৎপরতা শুরু হয়। শাসন কার্যের সুবিধা, আয়তন ও লোকসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় ১৯৬৯ সনে পটুয়াখালী জেলা সৃষ্টির সাথে মহকুমা শহর হিসাবে বরগুনা ইতিহাসের পাতায় স্থান পায়। কলাপাড়া, আমতলী,বরগুনা, বেতাগী এবং পিরোজপুর মহকুমার পাথরঘাটা এবং বামনা থানা নিয়ে বরগুনা মহকুমা গঠিত হয়। বরগুনা মহকুমা সদরের সাথে যোগাযোগের অসুবিধার কারণে পরবর্তীতে কলাপাড়া থানা পটুয়াখালী মহকুমার সাথে যুক্ত হয়। মহকুমায় রূপান্তরিত হওয়ার আগে থেকেই বরগুনা শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে অন্যান্য এলাকার সাথে তাল মিলিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। পরবর্তীকালে সময়ের প্রয়োজনে ১৯৮৪ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি বরগুনা মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়।