সোহেল হাফিজ : স্কুল থেকে এসে গোসল সেরে দুপুরের খাবার। খাবার শেষে ঘুম। ঘুম থেকে উঠেই সোজা ক্রিকেট ব্যাট নিয়ে পাড়ার মাঠে সব শিশুদের কোলাহল। এই তো কয়েকদিন আগেও সকল পরিবারের ছেলে শিশুদের নিত্যদিনের চিত্রটা ছিলো এমন। কন্যা শিশুরাও থাকতো বন্ধুদের সাথে পুতুল খেলায় কিংবা আড্ডায়।
আর এখন বদলে গেছে সকল চিত্র। স্কুল নেই। হাউজ টিউটর নেই। নেই বিকেল বেলার ক্রিকেট খেলাও। পাড়ার ওলিগলিতে এখন শোনা যায় না শিশু-কিশোরদের হৈচৈ-কোলাহলও। অধিকাংশ শিশুদের সময় কাটছে এখন ঘরবন্দি হয়ে। এর মধ্যে রয়েছে করোনাভীতি। অধিকাংশ শিশুরা এখন মানসিকভাবে বিপর্যস্ত।
যাদের ঘরে টেলিভিশন আছে তারা খানিকটা সময় টিভি দেখে কাটাতে পারলেও এখন অনেকটাই বিরক্ত তারা। এ ছাড়া করোনার ভয়াবহতার কথা শুনতে শুনতে অনেক শিশুই ভুগছে আতঙ্কে। আর গ্রামাঞ্চলের যেসব ঘরে টেলিভিশন নেই, নেই পর্যাপ্ত খাদ্যও, তারা এখন মহা বিপাকে। এসব শিশুদের নিয়ে বিপাকে তাদের বাবা-মায়েরাও।
অনেকক্ষেত্রেই বিভিন্ন পেশাজীবী বাবা-মাকে অতি জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে বের হতে হচ্ছে মাঝে মধ্যেই। এতে শিশুদের জন্যে বাড়ছে করোনা সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি। বরগুনা জেলা স্বাস্থ্য বিভাগসূত্রে জানা গেছে, বরগুনায় প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় গত নয় এপিল। আর আজ শুক্রবার সকাল পর্যন্ত মাত্র ১৫ দিনে মোট করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে ২৩ জনে দাড়িয়েছে। এদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুইজনের।
জেলা স্বাস্থবিভাগসূত্রে আরও জানা গেছে, আক্রান্তদের মধ্যে ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে শিশুদের সংখ্যা রয়েছে দুই জন। বরগুনা শহরের চরকলোনী এলাকার রাবেয়ামঞ্জিলের নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন গৃহবধূ জাফরিণ আক্তার (৩৮) বলেন, তাঁর দুই ছেলে। দুইজনের বয়স যথাক্রমে ১৩ এবং ১০। তাঁর ছেলেরা সুযোগ পেলেই বাইরে বের হতে চায়। বাইরে বের না হওয়ার জন্য তাদেরকে কড়া শাসনে রাখতে হচ্ছে। অন্যদিকে ঘরে বসে বসে দিন দিন বিরক্তও হয়ে পড়ছে তারা।
অন্যদিকে আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের হতদরিদ্র পরিবারের একজন সদ্যবিধবা গৃহবধূ সীমা আক্তারের সাথে মুঠোফোনে কথা বললে তিনি জানান, এক বছর আগে তাঁর দিনমজুর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে। ছোট ছোট এক ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে এখন তাঁর অচল সংসার। বাধ্য হয়ে দুই ছেলেমেয়েকে তাদের নানীর কাছে রেখে সীমা আক্তার রাজধানী ঢাকা উঠেছিলেন কাজের খোঁজে। এরপর ঢাকায় লকডাউন ঘোষণার পরে তিনি আটকে আছেন ঢাকার এক বস্তিতে। আর তার ছেলেমেয়েরা এখন কোনরকম এক বেলা আধাবেলা খেয়ে না খেয়ে আছে তাদের নানীর কাছে।
সদর উপজেলার আয়লা-পাতাকাটা ইউনিয়নের ইউপি সচিব মো. মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, সরকারিভাবে ভিজিডি, ভিজিএফসহ যেসব ত্রাণ দেয়া হয় তাতে শিশুদের জন্যে বিশেষ কোন খাবার থাকে না। এ বিষয়ে বিবেচনার জন্য উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বন জানান।
এ বিষয়ে শিশুদের নিয়ে কর্মরত উন্নয়ন সংগঠন সিবিডিপির নির্বাহী পরিচালক জাকির হোসেন মিরাজ বলেন, গ্রামাঞ্চলের দরিদ্র পরিবারের অনেক শিশুরাই এখন অপুষ্টিতে ভুগছে। বয়সন্ধিকালের কিশোরীদের জন্যে প্রয়োজন স্যানেটারি ন্যাপকিন। অথচ এখন যেসব সহায়তা দেওয়া হচ্ছে তাতে শিশু বান্ধব কোন খাদ্য বা পণ্য নেই।
এ বিষয়ে বরিশাল বিএম বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোর্শেদা নাজনীন বলেন, এ সময় শিশুরা মানসিকভাবে ভালো থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। দেশব্যাপী এই দুর্যোগে তাদের ভেতরেও অবশ্যই ভীতি কাজ করে। সরকারি-বেসরকারিভাবে শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব খাদ্য এবং পণ্য উপহার দেয়া বিশেষ জরুরি। তিনি আরও বলেন, শিশুদের জন্যে পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি কন্যা শিশুদের জন্য স্যানেটারি ন্যাপকিন এবং সকল প্রকার শিশুদের জন্য খেলার সামগ্রী যেমন ছোট ছোট বল, রং পেন্সিল, ছবি আকার খাতা, শিশুতোষ গল্প, কার্টুন কিংবা কমিক্সের বই ইত্যাদি উপহার দেয়া যেতে পারে।
এ বিষয়ে বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ইতোমধ্যেই তাঁরা পাঁচশত পরিবারে শিশুখাদ্যসহ উপহার বিতরণের পদক্ষেপ নিয়েছি। তারপরেও এ বিষয়ে সুপারিশ করে তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি প্রস্তাবনা পাঠাবেন বলে জানান।
সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ
আরো পড়ুন : ভিন্ন এক রমজান বিশ্বের ১৮০ কোটি মুসলিমের