সাজিদা ইসলাম পারুল, বরগুনা : একসময় দর্জি দোকানি সুজন বালাকে একা একাই টেনেটুনে চালাতে হতো পুরো পরিবার। চারজনের এ অভাবের সংসারে লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য ছিল আঠারো বছরের সুমি রানী বালার। তবে এতদিনে শৈশবের স্বপ্ন সত্যি হতে চলেছে তার। এ বছরই বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকে ভর্তি হচ্ছেন তিনি।
শুধু তাই নয়, নিজের ব্যবহৃত ক্যামেরায় বরগুনা সদর উপজেলা বটতলায় বসবাসরত এক পরিবারের নারী-পুরুষ সমতার ছবি তুলে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ের আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় সেরা আলোকচিত্রের পুরস্কারও অর্জন করেছেন সুমি।
এই আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার নির্বাচিত ৬০টি ছবি নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার দিনব্যাপী এক প্রদর্শনী হয় বরগুনা জেলা শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। সকাল ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এ প্রদর্শনী উন্মুক্ত ছিল সবার জন্য।
আলোকচিত্র তোলার পাশাপাশি বরগুনা জেলা সদর পৌরসভার থানাপাড়া এলাকায় ইথিকস ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে শিক্ষকতাও করছেন সুমি বালা। আয়ের টাকা দিয়ে সংসার চালাতেও সহযোগিতা করছেন বাবাকে। অদম্য সুমি সমকালকে বলেন, ‘অভাব মোরে পেছনে হালাইতে পারে নাই। তয় মা-বাফের উৎসাহ মোরে স্বপ্নপূরণে সাহায্য করছে। বিয়ের সোমোন্দ আইলেও মোর ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিছে মায়-বাফে।’ সেরা আলোকচিত্রীর পুরস্কার অর্জনের প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, ‘সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে বৈষম্য দূর করতে বান্ধবীগো লইয়া প্রতি শুক্কুরবার আলোচনায় বই। ছবি সমাজের চেহারাই বদলাইয়া দেতে পারে, হের লইগ্যাই প্রতিযোগিতায় যোগ দিছি।’
সুমির আলোকচিত্রে দেখা যায়, হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে আছেন অসুস্থ মা। পাশেই শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে আছেন বাবা। পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতার এই চিত্র প্রকারান্তরে নারী-পুরুষ সমতার ভাষ্যই তুলে ধরেছে। এই বার্তাই দিচ্ছে যে, নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক- তাই লিঙ্গবৈষম্য দূর করে গৃহস্থালির কাজে পুরুষের অংশগ্রহণও জরুরি এবং স্বাভাবিক।
সদর উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের গুলিশাখালী গ্রামের লামিয়া আক্তার। অভাব-অনটন লেগেই থাকে তাদের পাঁচ সদস্যের পরিবারে। বাল্যবিয়ের প্রবণতাও রয়েছে এই গ্রামে। কিন্তু ১৭ বছর বয়সী এই কিশোরীও সমাজের প্রতিবন্ধকতা ঠেলে লেখাপড়া করে চলেছেন। লামিয়াও পেয়েছেন আলোকচিত্রীর সেরা পুরস্কার। চা-শিঙাড়ার দোকানি লামিয়ার বাবা খলিলুর রহমান বলেন, ‘নদীভাঙনে মোরা সব হারাই। আবার গড়ি। তারপরও মেয়ের ল্যাহাপড়ার ইচ্ছারে বড় কইর্যা দেকচি।’
সুমি ও লামিয়ার মতো আরও দু’জন সেরা আলোকচিত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন এই বরগুনা জেলা থেকে। তারা হলেন- পৌরসভা এলাকার হাজারবিঘা গ্রামের জাহাঙ্গীর ও শাহানা বেগম দম্পতির মেয়ে নিরা আক্তার এবং তুলশীবাড়িয়া গ্রামের নিরঞ্জন হাওলাদার ও কল্পনা রানী হাওলাদার দম্পতির ছেলে মনমোহন হাওলাদার। লামিয়ার আলোকচিত্রের বিষয়বস্তু পুকুরের ধারে কর্মব্যস্ত স্বামী-স্ত্রী। নিরা আক্তারের আলোকচিত্রেও দেখা যায়, স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে গোসল করাচ্ছেন সন্তানকে।
সম্প্রতি গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডার সহায়তায় প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ ‘স্ট্রেনদেনিং হেলথ আউটকামস ফর ওমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’ প্রকল্পের আওতায় জাতীয় পর্যায়ে আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা করে। সারাদেশ থেকে শতাধিক প্রতিযোগীর প্রায় এক হাজারের বেশি ছবি জমা পড়ে। জাতীয় পর্যায়ের এই প্রতিযোগিতায় উপকূলীয় জেলা বরগুনার তিন মেয়ে ও এক ছেলের এমন সাফল্য সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ আয়োজিত এই আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার বিষয় ছিল জেন্ডার সমতা বাস্তবায়নে মা, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্য এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায় পুরুষের অংশগ্রহণ।
বরগুনার ছেলে দীপঙ্কর
এদিকে, বরগুনা জেলার সদর উপজেলায় ‘স্ট্রেনদেনিং হেলথ আউটকামস ফর ওমেন অ্যান্ড চিলড্রেন’ প্রকল্পের মাধ্যমে মা ও শিশু মৃত্যুহার কমিয়ে আনতে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে, স্বাস্থ্যসেবায় পুরুষের অংশগ্রহণ বাস্তবায়নে ও কিশোর-কিশোরীদের যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা দিতে আদ্-দ্বীন ওয়েলফেয়ার সেন্টার নিয়মিত কাজ করছে। বিভিন্ন পর্যায়ে কাজ করছেন এ সংস্থার প্রায় ১৩৮ জন কর্মী।
এ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক ড. শামছুর রহমান জানান, সদর উপজেলার মোট জনসংখ্যা দুই লাখ ৭৩ হাজার ৯১। এর মধ্যে নারীর সংখ্যা এক লাখ ৩৭ হাজার ১৯৮, পুরুষের সংখ্যা এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৩। এ উপজেলায় পরিবারের সংখ্যা ৬৯ হাজার ৯১০টি। তিনি বলেন, ‘মা ও শিশু মৃত্যুহার রোধে নয় হাজার ৯৯৮ জন কিশোর-কিশোরীকে যোগ্য করে তুলতে ১৬৬ জন পিয়ার এডুকেটরের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি উঠান বৈঠক পরিচালনা করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে এ সদর উপজেলার চার কিশোর-কিশোরী সফলতা এনেছে। যা আমাদের জন্য গর্বের।’
এই প্রকল্পের মাঠ সমন্বয়কারী মোর্শেদা পারভীনও তাদের সফলতায় খুশি হয়েছেন। তিনি বলেন, সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে ৭৪৭ পরিবারের ১২০ কিশোর-কিশোরীকে বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। তাদের এই শিক্ষা দেই- কীভাবে বাল্যবিয়ে ঠেকাতে হবে।’
প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জেন্ডার স্পেশালিস্ট ইরফাত আরা ইভা বলেন, ‘কন্যাশিশু ও ছেলেশিশুকে সমান সুযোগ দিতে হবে। যাতে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
সূত্র : সমকাল