‘ধরি ইলিশ খাই পাঙ্গাস’

বরগুনা অনলাইন ডেস্ক : বরগুনার পাথরঘাটার হরিণঘাটায় বিষখালী মিলেছে বঙ্গোপসাগরে। আবার ধানসিড়ি, সুগন্ধা নদী ও গাবখান চ্যানেল যেখানে মিলেছে, সেখানে উৎপত্তি বিষখালীর। এর দুই তীরে বরিশাল, ঝালকাঠি ও বরগুনার আটটি উপজেলা। মোট ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য নদীটির।

তবে বিষখালীকে বেশি পেয়েছে বরগুনা। বিষখালী সেই গুটিকয় জলাধারের একটি, যার মধ্য দিয়ে স্বাদু পানিতে ডিম ছাড়তে বের হয় মা ইলিশ। এ কারণে সারা বছরই নদীটিতে কমবেশি ইলিশ মেলে। নদীর তীর ধরে হাজার হাজার জেলে ও মাছ ব্যবসায়ীর বাস। তবে তাঁরা ভালো নেই। কারণ অনেক। আঠারো শতকে কম্পানির আমলে যখন প্রথম এখানে জেলেপল্লী গড়ে ওঠে, তখন সংখ্যাটি ছিল এখনকার তুলনায় অনেক কম।

জেলার নাম বরগুনা
বরগুনাকে ইলিশের জেলাও বলা হয়। এখানকার পাথরঘাটায় রয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) পরিচালিত দেশের বৃহত্তম মৎস্য বন্দর ও পাইকারি বাজার। কোটি কোটি টাকার মাছ এখানে কেনাবেচা হয়। অনেক রকম মাছই বিক্রি হয় বাজারে, তবে ইলিশই প্রধান আকর্ষণ।

মানুষ জানে, মাছের রাজা ইলিশ। তবে স্বাদের রাজা যে বিষখালীর ইলিশ, তা বেশি লোকের বুঝি জানা নেই। বরগুনার জেলা প্রশাসন গতবারই (২ অক্টোবর) প্রথম ইলিশ উৎসব করেছিল। এবারও হচ্ছে। দেশের তো বটেই, বিদেশ থেকেও ক্রেতা, বিক্রেতা, জেলে, ব্যবসায়ী বা দর্শনার্থী যোগ দেয় এই উৎসবে।

উল্লেখ্য, বিষখালীর ইলিশ কিনতে ক্রেতারা কেজিতে সাড়ে তিন শ টাকা বেশি গুনতেও রাজি থাকেন (সাগরের ইলিশের তুলনায়)। স্বাদের কারণেই বিষখালীর ইলিশের দাম চড়া থাকে। এই মাছ হয় হৃষ্টপুষ্ট। গায়ে তেল বেশি। চওড়া বেশি। রান্নায় ঘ্রাণ মোহিত করে প্রতিবেশীকে।

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘বিষখালীর ইলিশ খুবই স্বাদের মাছ। আমি অনেক খেয়েছি।’

পানির অনেক দাম
দাম দিয়ে কিনতে হয় বিষখালীর পানি। তবেই জাল পাতা যায়। সোজা কথায়, জাল পাতার নির্দিষ্ট স্থান ব্যবসায়ীদের কিনে নিতে হয়।

পাথরঘাটার ঘুটাবাছা গ্রামের জেলে ইসমাইল মিয়ার ছেলে মনির মিয়া। ২০ বছর হয়ে গেল মাছ ধরছেন। বলছিলেন, ‘যে জাল দিয়ে ইলিশ মাছ ধরি তার নাম সাইন জাল। জালের নিচের অংশে বাঁধা থাকে ভারী বস্তু এবং ওপরের অংশে ফ্লট (প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি জাল ভাসিয়ে রাখার হালকা বস্তু)। নদীর যে জায়গাটায় আমরা জাল পাতি, সেটুকু কিনতে (যিনি দখলে ছিলেন তাঁর কাছ থেকে।

উল্লেখ্য বালু তোলার স্থানব্যতিত নদীর ইজারা হয় না। ৭৫ হাজার টাকা লেগেছে। জায়গাটা প্রস্থে চার শ হাত। এটুকু জায়গা যদি নদীর খাড়ি মানে গভীরে হতো তাহলে তা কিনতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা লাগত। ঝালকাঠি থেকে পাথরঘাটা পর্যন্ত ১১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের নদীটিতে হাজার হাজার সাইন ও খুঁটা জাল (যে জাল খুঁটায় পাতা হয়) পাতা। সীমানা বিরোধে মাঝেমধ্যেই মারামারি ও মামলা হয়।’

মনিরের জীবন
মোটমাট এক লাখ টাকা দাদন (বাস্তবে গ্রহীতার জন্য ধার আর দাতার জন্য বিনিয়োগ) নিয়েছেন মনির। পাথরঘাটা শহরের এক আড়তদারের কাছ থেকে। প্রথমে নিয়েছিলেন ২৫ হাজার টাকা। খরচ করেছেন মাছ ধরার জাল কিনতে ও মেরামত করতে। পরের বছর এর সঙ্গে আরো ২৫ হাজার যোগ হয়। পরের বছর আরো ৫০ হাজার। মাছ ধরার ইঞ্জিনচালিত নৌকার মেরামত ও জাল কিনতে খরচ হয়েছে সেই টাকা।

আড়তদার টাকা পরিশোধে চাপ দেয় না। মাছ পেলে কিনে নেয় পাইকারি দরে। দাদনের কারণে চুক্তিবদ্ধ জেলে আড়তেই মাছ বিক্রি করতে বাধ্য হয়। অসুখবিসুখ বা জরুরি টাকার দরকার পড়লে আড়তদারই ৫-১০ হাজার টাকা ধার দেয়। প্রতিবারের মাছের দামের সঙ্গে ওই বাড়তি টাকা সহনীয় হারে উসুল করা হয়। বিক্রয়কালে এক মণ মাছ সমান ৪২ কেজি। এটাকে বলা হয় পাকা মাপ।

মনির বলেন, ‘দাদনের গোলকধাঁধা থেকে বের হতে অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু এ পেশায় থাকলে এটাই নিয়তি।’

সাধ ছিল
মনিরের সাধ ছিল একটি পাকা বাড়িতে বৃদ্ধ মা-বাবা ও সন্তান নিয়ে থাকবেন। সেই শিশুকাল থেকেই তাঁর এই সাধ। কিন্তু সাধ যে সাধ্যের ছায়াও মাড়াতে পারে না। দাদার ২৪ শতাংশ জমির ১৪ শতাংশে টিনের ঘর, আর ১০ শতাংশে ধান আবাদ করেন। সঙ্গে গাঁয়েরই আরেকজনের ২০ শতাংশ বর্গা নিয়েছেন। এ থেকে বছরের খোরাকি মজুদের চেষ্টা থাকে, কিন্তু সব সময় সমান ফলন হয় না।

মনির পড়াশোনা করেছেন ছোট পাথরঘাটা দাখিল মাদরাসায়। তাঁর তিন বোনকেও দাখিল পরীক্ষার আগেই বিয়ে দিতে হয়েছে। এখন মনির ছেলে ও মেয়েকে উচ্চশিক্ষিত করতেই দিনরাত খাটেন।

জোয়ার আর ভাটা
মনির বলছিলেন, ‘জোয়ার কখন আসবে তার হিসাব করে জাল ফেলি। ভাটা হওয়ার শুরুতে জাল তুলে ফেলি। সেটা কখনো কখনো গভীর রাতে, কখনো বা কাঠফাটা রোদে। কোনো কোনো দিন আবার দু-চারটা মাছ কেবল ধরা পড়ে। মৎস্য বিভাগের অভিযানের সময় তো জাল কাটাও পড়ে বা পোড়ানো হয়। তখন নতুন করে দাদন নিয়ে আবার শুরু করতে হয়।’

ধরি ইলিশ, খাই পাঙ্গাশ
পাথরঘাটার জেলে মনির, বেতাগী উপজেলার ঝোপখালী গ্রামের মো. মিরন, শানু হাওলাদার, কাঠালিয়া উপজেলার নদীতীরবর্তী জেলে আহমদ আলী এবং বাকেরগঞ্জের নেয়ামতির কালিচরণের সঙ্গে কথা বলে আরো জানা গেল, তাঁরা ধরেন ইলিশ, কিন্তু খান পাঙ্গাশ। অভাব তাঁদের ইলিশ খেতে দেয় না।

সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *