নলী চরকগাছিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষের বিদায়ী সংবর্ধনা ও পুনর্মিলনী

নলী চরকগাছিয়া এতিম মঞ্জিল সিনিয়র মাদরাসা

নিজস্ব প্রতিবেদক : প্রিয় শিক্ষকের প্রতি ভালোবাসার অনন্য নজির দেখালেন বরগুনা সদর উপজেলার ঢলুয়া ইউনিয়নের নলী চড়কগাছিয়া এতিম মঞ্জিল আলিম মাদরাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা। ৪২ বছর শিক্ষকতা করার পর মাদরাসাটির অধ্যক্ষ আলহাজ মাওলানা সুলতান মাহমুদ সম্প্রতি অবসরে গেছেন। তার বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ১৫ লাখ টাকার গাড়ি উপহার দিয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা।

মাদরাসার প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের সংগঠন আল মাহমুদ প্রাক্তন ছাত্র ফোরামের উদ্যোগে মাদরাসা প্রাঙ্গণে গত ২০ ফেব্রুয়ারি শনিবার ‘অধ্যক্ষ আলহাজ মাওলানা সুলতান মাহমুদের বিদায়ী সংবর্ধনা ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী-২০২১’ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আলহাজ মো: আল আমিনের সভাপতিত্বে বিদায়ী সংবর্ধনা ও পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরগুনা সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মো: মতিউর রহমান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরগুনা দারুল উলুম মডেল কামিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ আলহাজ মাওলানা আব্দুর রশীদ, বরগুনা দারুল উলুম মডেল কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মামুন অর রশীদ, পূর্ব ঘুদিঘাটা সালেহিয়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মাওলানা মো: ইলিয়াছ।

দিনব্যাপী আড়ম্বরপূর্ণ এ অনুষ্ঠানে মাদরাসার গভর্নিবডির সদস্যবৃন্দ, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ ও শিক্ষার্থীরা, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রায় ৮০০ প্রাক্তন শিক্ষার্থী অংশ গ্রহণ করেন। মাদরাসার সাবেক শিক্ষার্থীরা জানান, অধ্যক্ষ সুলতান মাহমুদ শিক্ষার্থীদের সন্তানের মত ভালোবেসে জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন। তার বদৌলতেই প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে দেশের সেরা ফলাফল অর্জনের গৌরব লাভ করেছে। আমরা তার ঋণ কখনো শোধ করতে পারবো না।

বিদায়ী সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মাদরাসাটির সদ্য বিদায়ী অধ্যক্ষ আলহাজ মাওলানা সুলতান মাহমুদ তার বক্তেব্যে বলেন, ‘বিদায় বেলায় ৪২ বছরের হাজারো স্মৃতি আজ হৃদয়ের পর্দায় ভেসে উঠছে। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিলতিল করে করে গড়ে তুলেছি প্রতিষ্ঠানটিকে। আমার স্বপ্ন ছিলো এই মাদরাসা দেশের একটি শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হবে। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দেশের কল্যাণে, দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করবে। আমি আমার স্বপ্নপুরণে সফল হয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘একজন ছাত্রকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই একজন শিক্ষকের জন্য পরম পাওয়া। এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের আমি সন্তানের মতো দেখেছি। মাদরাসাকে মায়ের মতো মনে করেছি। বিদায়ের এ ক্ষণে আমি অভিভূত। আমার ছাত্ররা দেশের কল্যাণে নিবেদিত হয়েছে।’

মাদরাসার প্রাক্তন ছাত্র ও ভোলা জেলার দায়রা জজ আদালতের যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ মো. জাকারিয়া তার বক্তব্যে বলেন, ‘অধ্যক্ষ আলহাজ মাওলানা সুলতান মাহমুদ এমন একজন শিক্ষক, যিনি প্রতিষ্ঠানটিকে ভালোবেসেছেন মায়ের মতো করে। শিক্ষার্থীদের শুধু পড়াশোনাই না, সন্তানের মতো যত্নে লালন করে আদর্শ ও নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়েছেন। মহান এই শিক্ষকের বিদায়ে আমরা তাকে উপহার দেব এমন কিছু নেই। তবুও সবার পরামর্শে তাকে আমরা একটি গাড়ি উপহার দিয়েছি।’

মাদরাসার সাবেক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকের ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর শাখায় ব্যবস্থাপক গোলাম কিবরিয়া বলেন, অন্তত ১০ থেকে ১৫ জন শিক্ষার্থী বিভিন্ন ক্যাডারে বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে দেশের সেবায় নিয়োজিত রয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানটি থেকে উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুনামের সাথে কর্মরত রয়েছেন।

মাদরাসার সাবেক শিক্ষার্থী ও হাইকোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার হারুর-উর-রশীদ বলেন, ‘স্যারকে আমার পিতার মতো শ্রদ্ধা করি। তিনি আমাদের সন্তানের মতো করে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করেছেন। মাদরাসাকে একদিকে যেমন টেনে তুলেছেন পরম যত্নে, তেমনি শিক্ষার্থীদের ভালো-মন্দে সবসময় পাশে থেকেছেন। আমরা স্যারের জন্য গর্বিত।’

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজক আল মাহমুদ প্রাক্তন ছাত্র ফোরামের সভাপতি আবু হানিফ নেসারী বলেন, ‘আমরা প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা উদ্যোগ নিয়ে স্যারকে ১৫ লাখ টাকায় গাড়িটি কিনে উপহার দিয়েছি। স্যারের কারণে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা আজ আলোকিত মানুষ। স্যারকে আমাদের দেয়ার কিছুই নেই। শুধুমাত্র সম্মানিত করার চেষ্টা করেছি। এজন্যই আমাদের আয়োজন ছিল।’

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানটির সহকারী অধ্যাপক মাওলানা মো. রুহুল আমীন, আল মাহমুদ প্রাক্তন ছাত্র ফোরামের সেক্রেটারি ও প্রতিষ্ঠানটির আরবি প্রভাষক মাওলানা মাসুম বিল্লাহ্, ঢলুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মোল্লা, সাবেক চেয়ারম্যান আজিজুল হক সপনসহ প্রতিষ্ঠানের সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা।

জানা গেছে, অধ্যক্ষ মাওলানা সুলতান মাহমুদ বরিশাল জেলার অন্তর্গত বাকেরগঞ্জের পূর্ব মহেশপুর গ্রামে ১৯৬১ সালে ১ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা মৌলভী আবদুল গনি সিকদার, মা মোসাম্মৎ ফাতেমাতুজ্জোহরা। সুলতান মাহমুদ ১৯৭৮ সালের ১ ডিসেম্বর নলী চরকগাছিয়া এতিম মঞ্জিল দাখিল মাদরাসায় সুপারেনটেনডেন্ট হিসেবে যোগ দেন।

পরে মাদরাসাটি ১৯৮৫ সালে আলিম শ্রেণীতে উন্নীত হলে তিনি এর অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার কর্মজীবনের উল্লেখযোগ্য সফলতা হচ্ছে একটি জীর্ণশীর্ণ মাদরাসাকে দেশসেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। প্রতিষ্ঠানটি মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে একাধিকবার মেধা তালিকায় প্রথম স্থানসহ অসংখ্য বোর্ড স্ট্যান্ডের মতো ফলাফল তার শিক্ষকতা জীবনে ঈর্ষণীয় সাফল্য এনে দিয়েছে। মাদরাসাটি জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে ১ নম্বর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পুরস্কৃত করার কৃতিত্বও তারই।

প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে তিনি ছিলেন ছাত্রদের প্রতি পরম মমতাবান। তাদের লেখাপড়ার জন্য জীবনের বেশির ভাগ সময় ও শ্রম তিনি কর্মস্থলেই ব্যয় করেছেন। অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানকে একটি সমৃদ্ধ অবস্থানে পৌঁছাতে।

তার হাতে গড়া ছাত্ররা জজ, ব্যারিস্টার, বিসিএস ক্যাডারসহ দেশে অনেক সম্মানজনক পদ ও পেশায় জড়িত, যা তার চাকরি জীবনে একটি বিরল কৃতিত্ব। ১৯৭৫ সালে মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ ৪২ বছর ২ মাস ধরে মাদরাসার শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন অধ্যক্ষ আলহাজ মাওলানা সুলতান মাহমুদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *