পিচ্চি একটা মেয়ে। আমার প্রতি তার আলাদা কোনো দুর্বলতা ছিল…..

মৌনিকে স্মরণ

রুয়েটে জয়েন করার বছর খানেক হবে সম্ভবত। ২০১৬র মাঝামাঝি। ফেসবুকে মেয়েটা নক করল। হাবিজাবি কথাবার্তা বলে শুরু করল। প্রথমে ফেইক আইডি মনে করে গায়ে মাখিনি। একদিন ইনবক্সে এই ছবিটা শেয়ার করে বললো “দেখোনা ভাই তোমার একটা ছবি স্কেচ করছি”। ছবিটা দেখে আমার খুবই ভালো লাগলো। জীবনে প্রথম কেউ আমার স্কেচ করলো। তবুও ভালোলাগা ছাপিয়ে তার বিষয়ে জানার চেষ্টা করলাম। তার তুমি করে বলাটা ভালো লাগেনি, অবশ্য তেমন গায়ে মাখিনি। ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো, পিচ্চি একটা মেয়ে। আমার প্রতি তার আলাদা কোনো দুর্বলতা ছিল সেরকমটা আমার কখনো মনে হয়নি। তার সার্কেলের বড় ভাই-আপু- বন্ধুদের কাছে আমার সম্পর্কে শুনেছে, কিছুটা আগ্রহ তৈরি হইছে। ফেসবুকে ফলো করছে কিছু দিন হলো এবং আমার ফেসবুকের কথাবার্তা তার ভালো লাগে। আমিও তারে স্কেচের জন্য কৃতজ্ঞতা এবং ভালো লাগা শেয়ার করে প্রাথমিক আলাপ শেষ করলাম।

একদিন শেষ বিকেল। রুয়েটের ব্যাচেলর টিচার্স কোয়ার্টারে থাকতাম। দুপুরের ঘুম শেষ করে অফিসে গেলাম। এটা নিয়ম করে করতাম এবং অনেক রাত অবধি থাকা হতো অফিসে। হঠাৎ মৌনির টেক্সট – কি খবর, কি করছ ভাই?
-অফিসে এলাম কেবলই….
– আমি তোমার ক্যাম্পাসের এডমিন বিল্ডিংয়ের নিচে, দেখা করব, সময় হবে তোমার?
– ওকে থাকো সেখানে, আমি বেরুচ্ছি।
এডমিন বিল্ডিংয়ের পূর্ব পাশটায় আমার অফিস ছিল। মিনিট দুয়েকের মধ্যে বের হয়ে দেখি সাইকেল হাতে একটা পাতলা গঠনের, শ্যামা বর্ণের, জিন্স আর ফতুয়া পড়া কিশোরী মেয়ে। মায়া ভরা চোখ, পাগলাটে ভাব। আমাকে দেখেই ডেকে উঠল – আমি মৌনি।
হাই/ হ্যালো! খবরাখবর বিনিময়ের পর বললো সে সাইক্লিং করে। শহরের মালোপাড়ার ঐ দিকে বাসা। আজ এদিকে এলো বন্ধুদের সাথে তাই আমারে নক করা।

যেহেতু শেষ বিকেল, অফিসে বসানোর সুযোগ ছিল না। আবার রুয়েটের একবারে ব্যস্ততম প্লেস প্রশাসন বিল্ডিংয়ের নিচে একজন শিক্ষকের একটা মেয়ের সাথে দাড়ায়ে কথা বলা নিয়ে আমিও বিব্রত। একজন সিনিয়র প্রফেসর ড. আইমান আলী (ছদ্মনাম) পাশ দিয়ে হেঁটে ক্যাম্পাস থেকে বেরুচ্ছেন। আমি অপ্রস্তুত বোধ করছিলাম। বিষয়গুলো রুয়েট কালচারের সাথে যায় না কিনা! শেষতক ল্যাঠা চুকানোর জন্য মেয়েটারে বললাম এখন তো সব বন্ধ তোমারে তো কিছু খাওয়াতে পারলাম না…
কথা শেষ করার আগেই বলল- তালাইমারীর মোড়ে চলো, চা খাওয়াবা।
আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। বললাম চলো তাইলে।
-চলো, সাইকেলে ওঠো!

অবাক হওয়া সামলে নিয়ে বুঝলাম এই মেয়ের তার ছেঁড়া আছে। বললাম -তুমি চাও তো সাইকেল পাশের স্ট্যান্ডে আটকে রাখো। চা খাওয়া শেষে যাবার পথে নিয়ে যেও। তালাইমারী ৩/৪ মিনিটের হাটা রাস্তা, সাইকেলে চড়তে ইচ্ছে করছে না। সে তা-ই করল।
তালাইমারীর মোড়ের চা দোকানদারের নাম ভুলে গেছি। এ দোকানেই রাজশাহীর মোট চায়ের প্রায় ৯০% খেয়েছি কলিগ, ছাত্র-ছাত্রী, বা রাজশাহীতে আগত মেহমানদের সাথে। সেটা কমফোর্ট জোন ছিল। স্বভাবতই সেখানে গিয়েই স্বস্তিবোধ করলাম। চায়ের অর্ডারের পর ব্যক্তি, পরিবার, পড়াশোনা বিষয়ে কথাবার্তা হলো। ততোক্ষণে তার এক ছেলে বন্ধু ফোনে যোগাযোগ করে এসে হাজির দোকানে। তার সাথেও পরিচিত হলাম। যতটা জানলাম অনেকটা উড়নচণ্ডী মেয়ে, বাবা-মা দুজনই শিক্ষক ছিলেন যদ্দুর মনে পড়ে। দাদীর সাথেই বেড়ে উঠা। ছেলে বন্ধুটার সাথে তারা কয়েকজন মিলে একটা গানের দল বা কিছু একটা করে। ছেলেটাও আমাকে জানে।

হঠাৎ মৌনির প্রশ্ন- তুমি সাইকেল চালাতে পারো?
– পারবোনা কেন? আমি তো একটা সাইকেল কিনব ভাবছি। রাত করে কোয়ার্টারে ফিরি। রাতে রিক্সা পাওয়া যায় না। পায়ে হেটে ১৫/২০ মিনিট যেতে হয়। রুয়েটের আবাসিক এলাকা তো জঙ্গল। সাপের ভয় করে। সাইকেল ভালো অপশন হবে হয়তো।
– নতুন কিনবা না পুরনো?
– কিনবো ঠিক করিনি। কোনরকম একটা হলেই হয়। যতটা কম দামে হয় ততই ভালো।
– চলো তোমারে আজকেই সাইকেল কিনে দেই। টাকা আছে সাথে?
– ক্যামনে কি? টাকা তো সমস্যা না, বুথ থেকে তোলা যাবে।
– রাজশাহী ভার্সিটির সামনে দিয়ে ঢাকা হাইওয়ে ধরে কাটাখালি যাওয়ার পথে রাস্তার পাশে কয়েকটা পুরনো সাইকেলের দোকান আছে। আড়াই-তিন হাজারে ভালো সাইকেল পাবা। আমারটাও সেখান থেকে কিনছি।
– তাই? আচ্ছা পরে এক সময় যাবো, আজ তো সন্ধ্যা হয়ে গেল।
– তোমার ব্যস্ততা না থাকলে চলো। কাছেই তো! ১০/১২ মিনিট লাগবে।
ছেলেটাও বললো স্যার ফ্রি থাকলে চলেন, আমাদের কাজ নেই।
– ওকে, চলো তাইলে।

রুয়েট গেইট সংলগ্ন রুপালি ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা তুলে একটা অটো নিয়ে গেলাম সাইকেলের দোকানে। সাইকেল দোকানের লোকজন তারে খুব ভালো করে চিনে। সাথে আরো বুঝলাম এখানে চুরি হয়ে যাওয়া সাইকেলও বিক্রি হয়। বললাম এখান থেকে কেনাটা তো সেইফ হবে না। দোকানদার বললো আমরা আপনাকে লাইসেন্স (রশিদ) দিবো, আপনার সমস্যা হবে না। এই ব্যবসা আমাদের বহু বছরের।
এবং মৌনি দেখে-বুঝে, ট্রায়াল দিয়ে ৩২৫০ টাকায় একটা সাইকেল কিনে দিলো।
সাইকেল কেনা শেষে সেদিনের মতো বিদায়। তারা অটোতে করে চলে গেল। আমি আমার সাইকেলে চেপে ক্যাম্পাসে ফিরলাম।

তারপর কথাবার্তা নিয়মিতই হতো। আরো কয়েকবার সে রুয়েট ক্যাম্পাসের কাছাকাছি এসে নক করছিল, আমি ব্যস্ততায় বা বাস্তবতায় দেখা করিনি বা করতে পারিনি। তাও মাঝে-সাঝে কথা হতো। তার ঢাবিতে চারুকলায় পড়ার ইচ্ছে। ছায়ানটে কাজ করার ইচ্ছে। আমিও চেষ্টা করেছি গাইড করতে। মাঝখানে যোগাযোগ কমে গেল। সে বছরের ডিসেম্বরের শেষ দিকে আমি বিয়ে করলাম। বিয়ের ২/৪ দিন পর মৌনির টেক্সট-
ভাই তুমি বিয়ে করছো! আমারে দাওয়াতও দিলানা?
জবাবে আমি লিখলাম – তুমি তো রাজশাহীতে থাকো, আর ঢাকায় অনেকটা হুটহাট করে খুব কম সংখ্যক পরিচিতজনরেই দাওয়াত করছি। তোমারে বাসায় দাওয়াত করবো রাজশাহীতে।
সে একটা হাসির ইমো রিপ্লাই করলো। তারপর আর কখনো নক করেনি। আর কখনো কথা হয়নি।

গতকাল জানলাম মেয়েটা মারা গেছে। কেউ লিখলো গলায় ফাঁস দিয়েছে, কেউ লিখলো অসুস্থ ছিল।
মৌনি তার কৈশোরে আমার জীবনের প্রথম স্কেচ করেছিল, হয়তো খেয়ালের বশে। সুবিশাল প্রশান্ত মহাসাগরের অনেকটা মাঝখানের এক ছোট্ট দ্বীপে বসে আমি তারে স্মরণ করছি পরম মমতায়, ভালোবাসায়, দোয়ায়। পরম করুনাময়ের ভান্ডারে অবুঝ মেয়েটার জন্য করুণার নিশ্চয়ই কমতি হবে না। আমার প্রার্থনায় তুমিও থাকবে মৌনি!

মৌনি-কে স্মরণ | দিদু মিয়া

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *