বরগুনার গোলগাছের গুড় এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে

গোল গাছের গুড়

হোসাইন আলী কাজী, আমতলী (বরগুনা) : উপকুলীয় অঞ্চল বরগুনার গোলগাছের গুড় এখন দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতে যাচ্ছে। এতে ভাগ্য ফিরছে তালতলী উপজেলার বেহেলা গ্রামের শতাধিক পারিবারের। গোল গাছের গুড় বিক্রি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন তারা। অর্থনৈতিক চাকা ঘুরাতে এবং ভালো লাভবান হতে চাষীরা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও গুড় বাজারজাতকরণে সরকারি সহযোগিতা দাবী জানিয়েছেন।

তালতলী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলায় ১২০ হেক্টর জমিতে গোল গাছের আবাদ হচ্ছে। ওই জমিতে অন্তত ২৫ হাজার গোল গাছ রয়েছে। এর মধ্যে কড়াইবাড়িয়া ইউনিয়েনর উত্তর বেহালা ও দক্ষিণ বেহালা গ্রামে অন্তত ২০ হাজার গাছ রয়েছে। অবশিষ্ট গাছ গেন্ডামারা, লাউপাড়া ও সকিনা  গ্রামে। গত ৫০ বছর ধরে এ গ্রামগুলোতে গোলগাছের চাষ হয়। গোল গাছের চাষ অত্যান্ত সহজলভ্য এবং লাভজনক। গোল গাছ চাষে খরচ কম এবং ব্যয়ের অনুপাতে আয় অনেকগুন বেশি। এগাছ চাষে রাসায়নিক সার কীটনাশক ও পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। গাবনা বা গোলগাছের বীজ নোনা জমিতে পুতে রাখলেই চারা গজায়। ম্যানগ্রোভ বা উপকুলীয় অঞ্চলে গোল গাছ প্রাকৃতিকভাবে জন্ম হয়। নিচুজলাভুমি ও খালের পাড় বিশেষ করে নোনা পানিতে গোল গাছ বেড়ে উঠে। গোল গাছের বাগানকে বলা হয় গোলবহর।

আষাঢ় মাসে গোল গাছের ডান্ডিতে গাবনা বা ফল ধরে। অগ্রহায়ণ মাসে গাছের ‘ডান্ডি নুইয়ে’ দেয় চাষীরা। পৌষ মাসে ওই ডান্ডি রসে ভার করানোর জন্য দোয়ায়ে দিতে হয়। ১৫ দিন দোয়ানোর পরে গাবনার আগাছা পরিস্কার করে ধারালো দা দিয়ে এক কোপে কেটে দিতে হয়। ডান্ডির কাটা অংশ তিন থেকে চার দিন শুকাতে হয়। এরপরে সকাল বিকেল দুই বেলা পাতলা করে ডান্ডি চেঁছে দিতে হয়। দই সপ্তাহ এভাবে চেঁছে দিতে হয়। দুই সপ্তাহ পরে ওই প্রক্রিয়াজাত ডান্ডি প্রতিদিন বিকেলে কেটে দিতে হয়। এরপরই প্রাকৃতিকভাবে বের হয় রস। ওই রস হাড়িতে সংগ্রহ করা হয়। পৌষ মাস থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হয়। ওই রস আগুনে জ্বাল দিয়ে ঘণ করে গুড় প্রস্তুত করা হয়। ঘণ গুড়কে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ছেঁকে খাটি গুড় করা হয়।

রস থেকে গুড় তৈরি ছাড়াও কেটে ফেলা গাছের ডান্ডি জ্বালনি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ঘরের ছাউনির জন্য গোল পাতাও বিক্রি হয় আলাদাভাবে। তালতলী উপজেলায় গোলগাছের রস থেকে বছরে অন্তত ১০ হাজার টন গুড় উৎপাদিত হয় এমন তথ্য উপজেলা কৃষি অফিসের।

শীত মৌসুমে গোল গাছে প্রচুর পরিমানে রস আসে। শীত যত বাড়ে রসও তত বৃদ্ধি পায়। ওই সময়ে ব্যস্ত সময় কাটায় গোল চাষীরা। কাকডাকা ভোর থেকে শুরু করে অর্ধ দুপুর পর্যন্ত চাষীরা রস সংগ্রহ এবং তাদের স্ত্রীরা আগুনে রস জ্বাল দেয়া কাজে ব্যস্ত থাকেন। এ সময় বদলে যায় গ্রামের পুরো চিত্র। শীত মৌসুমে উত্তর বেহালা, দক্ষিণ বেহালা, গেন্ডামারা, লাউপাড়া ও ছকিনা গ্রামের চাষিরা রস ও গুড় বিক্রি করে লাখ টাকা উপার্জন করে। চাষীরা এক কলস সুস্বাদু রস তিনশ থেকে চারশ টাকায় বিক্রি করছে। মানভেদে প্রতি কেজি গুড় একশ থেকে দেড়শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়ছে এ গুড়ের। এ গুড় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা তালতলীর বেহেলা, গেন্ডামারা, সকিনা ও লাউপাড়া গ্রাম থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়াও বেহালা গ্রামের শতাধিক পরিবারের স্বজনরা পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে থাকেন। ওই স্বজনরা বেহেলা থেকে গুড় নিয়ে যান। আস্তে আস্তে ভারতে ওই গুড়ের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। গত ১০ বছর ধরে ওই গুড় ভারতে যাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ওই গুড় ব্যাপক পরিসরে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও পাঠানো সম্ভব এমনটাই মনে করেন চাষী ও ব্যবসায়ীরা। চাষীরা অধিক লাভবান হতে সরকারিভাবে বাজারজাত করার দাবী জানিয়েছেন।
গোল গাছের গুড়

শুক্রবার বেহালা ও গেন্ডামারা গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, গোলপাতার রস সংগ্রহ আর গুড় (মিঠা) তৈরির কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন চাষী ও তাদের পরিবারে সদস্যরা। আবার কেউ গুড় বিক্রি করছেন। বেহালা গ্রামে বিশাল গোলবহর রয়েছে। শীতে এসব গাছ হয়ে ওঠে গাছিদের কর্মসংস্থানের মূল উৎস। গোলের রস সংগ্রহের প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকা সবাই গাছের মালিক নন। অনেক গাছের মালিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ও রস সংগ্রহের জন্য চুক্তিতে লোক নিয়োগ দিয়েছেন। চুক্তিভিত্তিক কর্মীরা মৌসুম জুড়ে রস সংগ্রহ ও গুড় উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।

বেহালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক বিকাশ চন্দ্র মন্ডল বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ব্যবসায়ীরা এসে বেহেলার গোলের গুড় কিনে নিচ্ছে। আবার সখের বসে অনেক মানুষ ভারতে স্বজনদের কাছে গোলের গুড় পাঠিয়ে দিচ্ছেন। দিন দিন ভারতে এগুড়ের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, গ্রামের শতাধিক পরিবার এ গুড় বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এটা অত্যান্ত লাভজনক। আমার ৩৫ টি গাছ রয়েছে। ওই গাছে দুই মণ গুড় পেয়েছি।

গোল চাষী দীলিপ কুমার হাওলাদার বলেন, শীতের শুরুতে গোলের গাছগুলো কাটার উপযোগী হয়। আমার ৩০০ টি গাছ আছে। নিজেই কেটে রস সংগ্রহ করে গুড় তৈরি করে বিক্রি করছি। এ গুড়ের প্রচার চাহিদা রয়েছে। চাহিদা মত আমি দিতে পারছি না। গুড় ছাড়াও রসের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। প্রতি কলস রস তিনশ থেকে চারশ টাকায় বিক্রি করছি। তিনি আরও বলেন, গত ১০ বছর ধরে আমি এ গুড় ভারতে থাকা আমার স্বজনদের কাছে পাঠাচ্ছি।

একই গ্রামের মনিকা রানী বলেন, ধানের চেয়ে গোলের রস ও গুড়ে আয় বেশি। রসের পাশাপাশি গোলপাতাও বিক্রি করা যায় এবং গোলের পরিত্যক্ত ডান্ডিও জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করা হয়। তিনি আরও বলেন, গোল গাছের গুড় দিয়ে আমার সংসার চলে। এ গুড় বিক্রি করে আমি পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোই আছি।

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন চাষী লাল চন্দ্র বলেন, আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে এ গুড় ভারতে পাঠিয়ে বিক্রি করছি। তবে সরকারিভাবে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা গেলে আরও লাভবান হওয়া যেত। সরকারিভাবে বাজারজাতকরণ এবং গোল বাগান প্রসারে ঋণের ব্যবস্থা করা হলে আমরা আরও লাভবান হতাম। গোলবাগান করার জন্য সরকারের কাছে ঋণ দেয়ার দাবি জানাই।

তালতলী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আরিফুর রহমান বলেন, গোল গাছের রস ও গুড় একটি সম্ভাবনাময় ফসল। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে গবেষণার মাধ্যমে চাষিদের প্রশিক্ষণ দেয়া গেলে চাষীরা আরও লাভবান হতো। ভালোভাবে গুড় তৈরি করে প্যাকেটজাত করা হলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও পাঠানো সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, গোলগাছের গুড় বাজারজাতকরণ ও দেশের বাহিরে রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *