মায়ের ঠাঁই গোয়াল ঘরে!

পাঁচ মাস গোয়াল ঘরেই থাকতে হলো এক বৃদ্ধা মাকে। তার নাম খবিরুন্নেসা (৭৫)। তাকে সেখানে প্রথমে গরুর রশি ও পরে কোমরে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে তার ছেলেরা। এমন অমানবিক ঘটনা ঘটেছে বরগুনা সদর উপজেলার গৌরিচন্না ইউনিয়নের চরধুপতি এলাকায়।

প্রতিবেশীরা জানান, বরগুনা জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহর নির্দেশে বুধবার (১৬ অক্টোবর) বৃদ্ধা মাকে উদ্ধার করে মেয়ে তাসলিমার জিম্মায় রাখা হয়েছে।

বরগুনার জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ বলেন, ‘ফেসবুকের মাধ্যমে বিষয়টি নজরে আসার সঙ্গে-সঙ্গে সেখানে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠিয়ে বৃদ্ধা মাকে উদ্ধার করা হয়েছে। বৃদ্ধা মাকে নতুন বস্ত্র ও নগদ অর্থ দিয়ে তার মেয়ের জিম্মায় রাখা হয়েছে। পুনরায় ছেলেরা যেন মায়ের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ না করতে পারে, সেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ছেলেরা আবারও মায়ের সঙ্গে এ ধরনের আচরণ করলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাকির হোসেন বলেন, ‘বিষয়টি চরম অমানবিক। এটি সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ছাড়া কিছু না। আমরা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাকে উদ্ধার করে মেয়ে তাসলিমার জিম্মায় দিয়েছি। ছেলেদের ভরণপোষণ নিশ্চিত করার নির্দেশ দিয়েছি। এর ব্যত্যয় ঘটলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গৌরিচন্না ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তানভীর হোসেন বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে বৃদ্ধা খবিরুন্নেসাকে যথাসাধ্য সহায়তা দেওয়া হবে। এছাড়াও তার ভরণপোষণ যেন নিশ্চিত করা হয়, সে ব্যাপারে ছেলেদের ডেকে ব্যবস্থা নেবো।’

মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) দিবাগত রাত ১০টার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে বৃদ্ধা খবিরুন্নেসাকে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি গোয়াল ঘরের বিছানায় শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় দেখা যায়। একটি নোংরা বিছানায় বসে তিনি নাতী-নাতনীদের ডাকছিলেন। বেঁধে রাখায় তিনি বিছানা ছেড়ে নামতেও পারছিলেন না। এমনকি মশার উপদ্রব থেকে রক্ষা পেতে মশারিরও কোনও ব্যবস্থা ছিল না। লোকজনের টের পেয়ে তিনি পরিচয় জানতে চান। এসময় ছেলেদের ব্যাপারে জানতে চাইলে খবিরুন্নেসা বলেন, ‘আপনারা কারা বাবা, মোর পোলারা ভালো, হ্যারা মোরে ঠিকমত খাওন-দাওন দেয়। মোর পোলাগো যেন কোনও সমস্যা না অয় বাবা।’

এসময় ছোট ছেলে বাচ্চুকে ঘরে পাওয়া যায়। বাচ্চু জানান, তিনি মায়ের ঠিকমতো ভরণপোষণ দিচ্ছেন। গোয়াল ঘরে কেন রাখলেন, জানতে চাইলে বাচ্চু দাবি করেন ‘মায়ের মাথায় সমস্যা, আমি বাইরে কাজে ব্যস্ত থাকি, মা কোথায় কখন চলে যায়; তাই বেঁধে রেখেছি।’

বড় ছেলে বাদলকে ঘরে পাওয়া যায়নি। তার স্ত্রী বেবি জানান, শাশুড়ি মানসিক রোগী। সে কারণে তাকে ছেলেরা বেঁধে রেখেছেন।

প্রতিবেশী হুমায়ুন কবীর জানান, খবিরুন্নেসা দুই ছেলে ও তিন মেয়ের জননী। দুই বছর আগে স্বামী আবদুল হামিদ খান মারা যাওয়ার পর সহায় সম্পত্তি ছেলে-মেয়েরা ভাগ বাটোয়ারা করে নেন। মা খবিরুন্নেসার ভরণপোষণ নিয়ে ছেলেদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। এ নিয়ে বৈঠক হয়। দুই ছেলে ভরণপোষণের ভার বহন করবে এমন সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু, ছেলেদের কেউই ঠিকমতো মায়ের যত্ন নেননি। রোগে-শোকে কাতর খবিরুন্নেসার শারীরিক অবস্থারও অবনতি হতে থাকে। একপর্যায়ে ছেলেরা মাকে গোয়াল ঘরে বিছানা পেতে সেখানে ফেলে রেখে। মাত্র একবেলা খাবার দিতো।

প্রতিবেশীরা জানান, পাঁচ মাস ধরে মা খবিরুন্নেসাকে গোয়াল ঘরে বেঁধে রাখা হয়। একদিন রশি খুলে তিনি মেয়ের বাড়িতে যাওয়ার পথে ফের তাকে ছেলেরা ধরে এনে একইস্থানে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখে। বাঁধা অবস্থায় প্রায় ৫ মাস তিনি গোয়াল ঘরেই জীবনযাপন করেন। বয়সের ভারে কানে একটু কম শুনলেও খবিরুন্নেসাকে তারা স্বাভাবিক হিসেবেই জানেন। মূলত জমি-জমা ভাগ বাটোয়ারা হওয়ার পর ছেলেদের কেউ বৃদ্ধা মায়ের যত্ন নিতে রাজি নন। যে কারণে তাকে অযত্ন-অবহেলায় গোয়াল ঘরে ফেলে রাখা হয়েছে। যেন কোথাও যেতে না পারেন, কোমরে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। ওই গোয়াল ঘরেই দিনে একবার তাকে খাবার দেওয়া হতো।

বাংলা ট্রিবিউন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *