রুদ্র রুহান : টানা এক মাস ধরে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন ডা. কামরুল আজাদ (৪১)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, কোনো চিকিৎসক সাত দিন করোনা রোগীর চিকিৎসা দিলে তাকে পরের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়। কিন্তু এমনটা করতে পারছেন না ডা. কামরুল। কারণ, তিনি ওই হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।
ডা. কামরুল বলেন, ‘পরিবারের সবাই ঢাকায় থাকেন। সাত বছর বয়সী ছেলে, স্ত্রী, উচ্চ মাত্রার ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বাবা-মা ও ক্যানসারে আক্রান্ত শাশুড়ির দেখভালের দায়িত্ব আমার। দেশের দুর্যোগে পরিবারের কথা ভেবে নিজেকে গুটিয়ে নিতে মন সায় দিল না। স্ত্রীকে জানাই। ও প্রথমে কিছুটা নীরব ছিল। এরপর বলল, দেশের মানুষের টাকায় তুমি পড়াশোনা করে চিকিৎসক হয়েছ। এর বদৌলতে আমরা মর্যাদাপূর্ণ একটা জীবন পেয়েছি। দুর্দিনে তুমি তাদের পাশে থাকো। সংসার, সন্তান, পরিবার আমি সামলে নেব।’
১৯ মার্চ এক দিনের করোনা প্রশিক্ষণে ঢাকায় যান কামরুল আজাদ। প্রশিক্ষণ শেষে রাতে ঢাকার বাসায় গিয়ে প্রচণ্ড জ্বরে পড়েন। পরের দিন আইইডিসিআরে নমুনা দেন। পরীক্ষায় ফল করোনা নেগেটিভ আসে। তিনি বরগুনায় চলে আসেন। আসার সময় ছেলেটা জড়িয়ে ধরে তাকে বলছিল, ‘বাবা তুমি কবে আসবে?’ তিনি কোনো উত্তর দিতে পারেননি।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের ৫০ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ডের দায়িত্ব কামরুল আজাদের ওপর। করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে এ পর্যন্ত এখানে আসা ৬১ জনকে চিকিৎসা দিয়েছেন তিনি। তাদের মধ্যে ১০ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার তার তত্ত্বাবধানে এখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২১ জন। হাসপাতালে বক্ষব্যাধি ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের পদ শূন্য থাকায় তাকেই সামলাতে হচ্ছে করোনা রোগীদের।
বরগুনা জেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও জ্বর–সর্দির মতো উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীদের চিকিৎসায় কামরুল আজাদই একমাত্র ভরসা। ফলে সারা দিন ডিউটি করে নতুন রোগী এলে রাত ১২টায়ও তাকে ছুটতে হচ্ছে হাসপাতালে। পাশাপাশি মেডিসিন ওয়ার্ডের নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসা, জেলার অন্য হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণও দিচ্ছেন তিনি। চীনফেরত এক ছাত্রের করোনা উপসর্গের চিকিৎসা দিতে গিয়ে বরিশাল বিভাগে তিনিই প্রথম আইসোলেশন ওয়ার্ড চালু করেন।
স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি হাসপাতালে করোনা ইউনিট স্থাপনের নির্দেশ আসে। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে সে রকম অবকাঠামো ছিল না। এরই মধ্যে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে চীনফেরত এক ছাত্র বরগুনায় আসেন করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে। তখন করোনা চিকিৎসায় কোনো চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ ছিল না। প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় কেউ এগিয়ে আসার সাহস দেখাননি। তখন কামরুল আজাদ এগিয়ে এলেন। হাসপাতালের সীমিত অবকাঠামোর মধ্যে ওই ছাত্রকে আইসোলেশনে রাখার ব্যবস্থা করেন। ইন্টারনেট ঘেঁটে তিনি ওই ছাত্রকে চিকিৎসাসেবা দেন। ঢাকার রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (আইইডিসিআর) ওই ছাত্রের নমুনা পরীক্ষায় করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। কিন্তু তিনি তাকে ১৪ দিন এখানে রেখে চিকিৎসা দেন।
মার্চের মাঝামঝি হাসপাতালের ২৫০ শয্যার নিমার্ণাধীন নতুন ভবনে করোনা ইউনিট খোলা হয়। কিন্তু এই ভবনের দরজা–জানালা লাগানো ছাড়া আর সব কাজ বাকি ছিল। কামরুল নিজে এবং হাসপাতালের অন্যদের কাছ থেকে অর্থ তুলে নিজের মতো করে সাজালেন করোনা ইউনিট। ১৯ মার্চ ঢাকায় একদিনের করোনা প্রশিক্ষণের জন্য একজন চিকিৎসককে ডাকা হলো। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সব চিকিৎসককে নিয়ে বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিলেন, ডা. কামরুলই যাবেন।
এ বিষয়ে ডা. কামরুল আজাদ বলেন, ‘কিছু না ভেবেই হ্যাঁ বললাম। নিজের ও পরিবারের কথা মাথায় আসেনি। শুধু মনে হয়েছে, এই সংকটকালে বিপন্ন মানুষগুলোর পাশে থাকতে হবে, বাঁচানোর প্রচেষ্টা করতে হবে। একজন চিকিৎসক ও একজন মানুষ হিশেবে এখনই নিজের কাছে নিজের পরীক্ষা দেওয়ার উত্তম সময়। এই সংকটকে একটা যুদ্ধ হিসেবে নিয়েছি। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেই মুখগুলো, যে মুখে শুধু করোনা থেকে বাঁচার আকুতি।’
শুধু চিকিৎসাসেবা নয়, নিজের বেতনের টাকায় রোগীদের পুষ্টিকর খাবার কিনে দেওয়ার চেষ্টা করেন কামরুল আজাদ। চিকিৎসার পাশাপাশি রোগীদের মানসিক শক্তি জোগাতে তিনি কাউন্সেলিং করছেন। হাসপাতাল চত্বরে নিজের অর্থে তাঁবু খাঁটিয়ে করোনাভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে আসা রোগী ও সাধারণ রোগীদের বাছাইকরার জন্য দুই কক্ষের একটি রোগী শনাক্তকরণ জোনও খুলেছেন তিনি।
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন, এমন দুজনের সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। ঢলুয়া ইউনিয়নের খাকবুনিয়া এলাকার ওই ব্যক্তি তাবলীগ জায়াতে থাকার সময় করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘কামরুল স্যার শুধু ডাক্তার নন, তিনি এমন একজন মানুষ, যার সংস্পর্শে থাকলে মানুষ রোগ-শোক সব ভুলে যায়। স্যারের জন্য মনোবল হারাইনি, বেঁচে থাকার ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে। স্যারকে আমৃত্যু দোয়া করব, তিনি যেন ভালো থাকেন।’
অপরজন সদর উপজেলার কেওড়াবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা। তিনি বলেন, ‘স্যারকে দেখলেই মনে হতো, আমার কিছু হয়নি। তিনি বারবার বলতেন, এই তো ক’টা দিন, শিগগির বাড়ি ফিরবেন সুস্থ হয়ে। স্যারের কথা শান্ত্বনা মনে হলেও এখন সেটাই সত্যি।’
বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক সোহরাফ হোসেন বলেন, ‘একজন এফসিপিএস চিকিৎসক হয়েও তিনি যেভাবে একটানা কাজ করছেন, সেটা সারা দেশের স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য অনুকরণীয়। আমরা উনাকে বারবার বলি, আপনি সুস্থ থাকার জন্য বিশ্রাম নিন। তিনি বলেন, আমি বিশ্রামে গেলে এই রোগীদের কী হবে? এই জেলায় প্রশিক্ষিত করোনা চিকিৎসক হিসেবে তিনিই একমাত্র ভরসা। তাকে নিয়ে আমরা গর্বিত।’
সূত্র : রাইজিংবিডি
আরো পড়ুন : মাস্ক দিন অথবা পালাতে দিন : বরগুনার এক ডাক্তারের আকুতি