খায়রুল বাশার আশিক : বলেশ্বর নদের জল পেছনে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের জলতরণী। দূর থেকে দেখা যাচ্ছিল অস্পষ্ট একটি সবুজ বেষ্টনীর দ্বীপ। বিহঙ্গ দ্বীপ যার নাম। বলেশ্বর নদের বুকে জেগে থাকা এ দ্বীপটির সুখ্যাতি ছড়িয়েছে ভ্রমণপিপাসুদের মুখে মুখে। সেসব শুনে নিজ চোখে দেখার লোভ জাগল। তাই অথৈ জলরাশিতে ঘেরা সেই সবুজ স্বর্গটি দেখতে আমাদের ভ্রমণযাত্রার সূত্রপাত। আমাদের আজকের গন্তব্য বিহঙ্গ দ্বীপ।
সুন্দরবনের কূলঘেঁষে বলেশ্বরের অবস্থান। যার পূর্বে অবস্থিত বরগুনা জেলার পাথরঘাটা এবং পশ্চিমে ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন। বলেশ্বরের ঠিক মাঝখানে প্রায় ১৫০ একরজুড়ে গোলাকার আকৃতির এ দ্বীপের অবস্থান। আনুমানিক ২০ বছর আগে জেগে উঠেছে বিশাল এ দ্বীপ। আস্তে আস্তে প্রকৃতি তা নিজের খেয়ালে সাজিয়ে নিয়েছে। দ্বীপ সন্নিকটের বাসিন্দা ও জেলেদের আনাগোনা শুরুর পর থেকে দ্বীপটি নজরে আসে স্থানীয় পর্যটকদের।
জলসীমা মাড়িয়ে খুব কাছাকাছি পৌঁছাতেই স্পষ্ট হতে থাকে তার সবুজ শোভা। মাঝি ট্রলারের গতি কমিয়ে দেওয়ায় কমে আসে ইঞ্জিনের শব্দ। ফলে স্পষ্ট শোনা যায় পাখির কিচিরমিচির ডাক। দূরের সাদা গাঙচিল, বক, চেগা পাখির খুনসুটির সে দৃশ্য ছিল মুগ্ধকর। পাখির ডাকাডাকি শুনে মনে হবে ওরা যেন একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ডেকে চলেছে। এ যেন এক উন্মুক্ত পৃথিবীর স্বাধীনতা উপভোগের প্রতিযোগিতা।
দ্বীপে পা রাখা মাত্র মনে হচ্ছিল, আমরা প্রবেশ করেছি প্রকৃতির আপন খোয়ালে সাজানো এক মায়াবী মানচিত্রে। জলরাশিকে স্থায়ী প্রহরী নিযুক্ত করে নীল আকাশের নিচে নদীমাঝে প্রকৃতি সাজিয়েছে অপরূপ দৃশ্যপট।
পুরো দ্বীপের চারপাশেই বালুচর। সূর্যের রোদে সেই বালু উত্তপ্ত হয়, আবার বাতাসের পরশে তা ঠাণ্ডা হয়। সাদা বালুতে লাল কাঁকড়াগুলো যেন লালগালিচা বিছিয়ে রাখে। বালুর বুকে কাঁকড়ার শিল্পকর্ম সজ্জিত হয়েছে বালুচর। শামুকের আলসেপনায় রোদ পোহানো আর মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে খোলসের আবরণে দ্রুত মুখ লুকিয়ে নেওয়ার দৃশ্য বহুবার চোখে পড়ে কিছুক্ষণ এখানে হাঁটলেই। বনের মধ্যে পায়ে হাঁটা পথে কিছুদূর এগোলেই দেখা মিলতে পারে মায়াহরিণ। এ ছাড়া দেখা যাবে বনমোরগ, কাঠবিড়ালি, গুইসাপসহ নানান বন্যপ্রাণী। অবাধ ছোটাছুটিতে ব্যস্ত তারা। এসব প্রাণী নিকটবর্তী সুন্দরবন থেকে এসে বসতি গড়েছে বাঘমুক্ত এই দ্বীপে।
বিহঙ্গ দ্বীপের অধিকাংশ জায়গা দখল করে নিয়েছে হরেক বৃক্ষরাজি। দেখা যাবে কেওড়া, গেওয়া, পশুর, ছৈলা, বাইন, করমজা, খলিসা, সুন্দরীসহ নানা প্রজাতির গাছ। দ্বীপজুড়ে ফুটেছে নানা রঙের ফুল। বুনো সেসব ফুল বাতাসের পরশ পেলেই নাচ তোলে যখন-তখন। ঢেউয়ের গর্জন আর সূর্যাস্ত অবলোকন এ দ্বীপ ভ্রমণের উপরি পাওনা। সবুজের মায়াজাল বিছানো এই দ্বীপ, উপকূলের ভ্রমণ সম্ভাবনার অন্যতম ভরসা হয়ে উঠছে দিন দিন।
নামকরণ : স্থানীয় কয়েক সংবাদকর্মী, উন্নয়নকর্মী ও পর্যটক মিলে নামকরণ করেছেন এ দ্বীপের। প্রবীণ সাংবাদিক মির্জা শহিদুল ইসলাম খালেদ, পাথরঘাটা প্রেসক্লাবের সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘আস্থা’র সভাপতি ও গবেষক শফিকুল ইসলাম খোকন, পর্যটনপ্রেমী আলোকচিত্রী আরিফুর রহমান, প্রত্যয়ের সভাপতি চিত্রশিল্পী মেহেদি শিকদার, সাংবাদিক এ এস এস জসিম, আবুজর ইবতে রাফি, শিক্ষার্থী মো. বাইজিদ, জেলে মোস্তফা মুন্সী ২০১৫ সালের মাঝামাঝি এ দ্বীপে গিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। স্থাপন করেন ‘বিহঙ্গ দ্বীপ’ লেখা নামফলক। পরে তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে স্থানীয় প্রশাসন, উপজেলা পরিষদ, বন বিভাগ, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনসহ স্থানীয় বাসিন্দারা। পরে বরগুনা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি নামফলক স্থাপন করা হয়। এই নামকরণের আগে স্থানীয় জেলে ও মাঝিরা এ দ্বীপটিকে ধানসির চর বলেই জানত।
যাতায়াত : ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনা লঞ্চে পাথরঘাটা উপজেলাধীন কাকচিড়া লঞ্চঘাটে নামতে হবে। ভাড়া ডাবল কেবিন ২২০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন ১২০০ টাকা এবং ডেকে ২০০ টাকা। এরপর স্থানীয় যানবাহনে পাথরঘাটা সদরে যেতে হবে। অথবা সায়েদাবাদ কিংবা গাবতলী থেকে সড়কপথে সরাসরি পাথরঘাটা যাওয়া যায়। ভাড়া বাসভেদে ৭০০-১০০০ টাকা। এরপর পাথরঘাটার রুহিতা বটতলার পাশেই বলেশ্বর নদ। সেখান থেকে রিজার্ভ ট্রলার নিয়ে বিহঙ্গ দ্বীপ। ট্রলার ভাড়া কমবেশি ৪০০ টাকা। বিহঙ্গ দ্বীপের পাশাপাশি ভ্রমণ করুন হরিণঘাটা বনকেন্দ্র ও লালদিয়ার চর।