বরগুনা অনলাইন ডেস্ক : বাঁচার তাগিদেই জেসমিন এখন বরগুনা শহরের ‘পানিওয়ালা’। রেস্টুরেন্ট-দোকান আর বাসাবাড়িতে কলসে করে খাবার পানি সরবরাহ করে সংসার চলছে তার। খবর রাইজিংবিডি’র।
বরগুনা শহরের ক্রোক এলাকার খাল পাড়ে ঝুপড়ির মত বাসা। এখানে স্বামী সন্তান নিয়ে জেসমিনদের বসতি। এই সংসারটির পুরো ভারই জেসমিনের কাঁধে।
কিশোরিকালে জেসমিনের বিয়ে হয় বেতাগী এলাকার হানিফের সঙ্গে। হানিফ ওই সময়ে বরগুনা শহরে রিকশা চালাতেন। শহরেই ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া নিয়ে বসবাস শুরু করেন তারা। এভাবেই সংসার যাত্রা শুরু হয়েছিল জেসমিনের। কিন্তু বিয়ের পর একের পর এক নানা অঘটনে জেসমিনকেই দায়িত্ব নিতে হয় সংসারের। কীভাবে? সেও আরেক গল্প।
বিয়ের পরই দেখেন, স্বামীর টানপোড়েনের সংসার। রিকশার চাকা না ঘুরলে খাবার জোটেনা। এ অবস্থায় কেটে যায় দীর্ঘ বছর। এরই মধ্যে হানিফ-জেসমিন দম্পতির ঘরে জন্ম নিয়েছে একটি ছেলে। স্বামী হানিফের কাজের সক্ষমতা কমে যায়। স্বামীর আয়ে আর সংসার চলে না। শেষ পর্যন্ত জেসমিন নিজেই নেমে পড়েন কাজে। প্রথমে ইট পাথর ভাঙা, এরপর নির্মাণ শ্রমিকদের সহযোগী। হঠাৎ করেই স্বামী হানিফ দুর্ঘটনার শিকার হন। চেয়ে চিন্তে স্বামীর যতটুকু সাধ্য চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু সুচিকিৎসার অভাবে আর সুস্থ হননি হানিফ। শয্যাশায়ী হয়ে আছেন আজ ১২ বছর।
এরমধ্যে নির্মাণ শ্রমিকদের সঙ্গে কাজের সুযোগও হারিয়ে ফেলেন জেসমিন। দিশেহারা হয়ে পড়েন। কী করবেন ভেবে অস্থির। হঠাৎ দেখা হয় ‘পানিওয়ালা’ এক নারীর সঙ্গে। তার সঙ্গে কথা হয় জেসমিনের। অবশেষে ঠিক করেন রেস্টুরেন্ট-দোকান আর বাসাবাড়িতে কলসে করে খাবার পানি সরবরাহ করবেন। কয়েকজন দোকানির সাথে আলাপ হয়। পরের দিন কলস কিনে নিয়ে শুরু করেন পানি সরবরাহের কাজ। টাকা সঞ্চয় করে কিনেছেন পুরনো একখানি ভ্যান।
জেসমিন বলেন, ‘ফয়জরের আয়জান দেলেই কলস লইয়া নাইম্মা যাই, টিউবয়েলে যাইয়া কলস ভইর্যা ভ্যানে লইয়া দোকানে দোকানে পানি দিয়া আসি। বিকালে আবার নামি, রাইত পর্যন্ত পানি দেওয়ার কাজ করি’।
ছেলে সোহেল পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। পড়ালেখার ফাঁকে মাকেও সাহায্য করে। মা-ছেলের দিনভর এই যুদ্ধে রোজগার হয় দু’শ থেকে আড়াইশ টাকা। বেশ ভালই চলতে থাকে টানাপোড়েনের সংসার।
জেসমিনের মত ক্রোক এলাকার খালের পাড়ে আরো তিন নারীর বসবাস। তারাভানু, নাসিমা ও কাজল। এদের মধ্যে কাজলের শুধু স্বামী আছে, তারাভানুর স্বামী মারা গেছেন ১২ বছর আগে আর নাসিমাকেও স্বামী ছেড়ে গেছে প্রায় ১৫ বছর। প্রত্যকেরেই একাধিক সন্তান রয়েছে। মধ্যবয়স পেরিয়েছে প্রত্যেকেরই। পানি সরবরাহ করেই সেই রোজগার দিয়েই বেঁচে আছেন তারা।
বরগুনা শহরে এমন আরো অর্ধশতাধিক নারী রয়েছেন যারা একইভাবে রেস্টুরেন্ট ও বাসা বাড়িতে খাবার পানি সরবরাহ করেন। এদের বেশিরভাগই বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা, আবার কারো কারো স্বামী অসুস্থ।
বৈশ্বিক মহামারি করোনায় যখন জীবনযাত্রা অচলপ্রায়, তখন পানি সরবরাহের কাজও বন্ধ হয়ে যায়। দিন এনে দিন খাওয়া এই মানুষগুলোর জীবনে নেমে আসে চরম দুর্ভোগ। রোজগার বন্ধ তো খাবারও বন্ধ। কিছুদিন চেয়ে চিন্তে খাবার জুটলেও অধিকাংশ সময়েই তাদের না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। ধার দেনা আর ঋণের বোঝা চেপেছে অনেকের মাথায়। দোকানপাট খুলে দেয়া হলেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। বাসা বাড়িতে এখনো পানি সরবরাহ বন্ধ প্রায়।
জেসমিন বলেন, ‘আগে যহন পানি টানতাম তহন দুইশ তিনশ টাহাও পাইছি, এহন একশ টাহাও পাইতে কষ্ট অয়, কোনো কোনোদিন ৫০ টাহাও রোজগার করি। এইয়া দিয়া নিজেরা খামু না মানের দেনা দিমু’।