মুঘল নিদর্শন বিবিচিনি শাহী মসজিদ বিভাগঃ দর্শনীয় স্থান আগস্ট ২৭, ২০১৫; ৯:২১ অপরাহ্ণ 1,269 বার দেখা হয়েছে মুশফিক আরিফ দূর থেকে চোখে পড়ল ছোট্ট টিলার উপরে দাঁড়িয়ে এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি। গম্বুজ জড়িয়ে আছে শেষ বিকেলের সোনালী আলো। চারপাশে খেজুরসহ নানা ধরনের গাছ। সবুজের হাতছানিকে পাশ কাটিয়ে কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উঠলাম। ভেতরটা দেখতে তর সইছিল না। মসজিদের সামনের পাকা মেঝেতে বসতেই চারদিকে চোখ গেল। বাহ! চমৎকার পরিবেশ, মন জুড়িয়ে গেল নিমিষেই। এ হলো দক্ষিণাঞ্চলে মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম প্রাচীন নিদর্শন বিবিচিনি শাহী মসজিদ। আঞ্চলিক মহাসড়ক ধরে বরিশাল যেতে পড়বে বেতাগী উপজেলার বিবিচিনি গ্রাম। বরগুনা শহর থেকে যার দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিমি। সেখানে দিগন্ত জোড়া সবুজের মাঝে ৩০ ফুট উঁচু টিলার উপর দাঁড়িয়ে আছে বিবিচিনি শাহী মসজিদ। একে দক্ষিণ বাংলার ইসলাম প্রচারের কেন্দ্র হিসেবে অভিহিত করা হয়। তবে কালের বিবর্তনে এর ঐতিহ্য অনেকটা হারিয়ে গেছে। তবুও টিকে থাকা ধ্বংসাবশেষ পুরনো ঐতিহ্য ও শৌর্য-বীর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মসজিদের হারানো জৌলুস নিয়ে নানা কথা প্রচলিত রয়েছে। রয়েছে অনেক অলৌকিক কাহিনী ও ইতিহাস। সাধক নেয়ামতুল্লাহ শাহের কন্যা চিনিবিবি ও ইছাবিবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে বিবিচিনি গ্রামেরও নামকরণ। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে বাংলার মুঘল স্থাপত্যশিল্প এবং এলাকার পুরনো দিনের নানা স্মৃতি ও ঐতিহ্য। আরো পড়ুন : সোনাকাটা সমুদ্র সৈকতবলা হয়ে থাকে, সম্রাট শাহজাহানের সময় ১৬৫৯ সালে শাহ নেয়ামতুল্লাহ পারস্য থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশে দিল্লিতে আসেন। ওই সময় সম্রাটের দ্বিতীয় ছেলে ও বঙ্গ দেশের সুবাদার শাহ সুজা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। পরে ইসলাম প্রচারে নেয়ামতুল্লাহ শিষ্যসহ বজরায় চড়ে গঙ্গা নদী অতিক্রম করে বিষখালী নদীতে (তৎকালীন চন্দ্রদ্বীপে) নোঙ্গর করেন। তখন শাহ সুজার অনুরোধে ওই গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন। শাহ নেয়ামতুল্লাহর নামের সঙ্গে মিল রেখেই বিবিচিনি গ্রামের পার্শ্ববর্তী গ্রামের নাম নেয়ামতি। এক সময় অঞ্চলটি ছিল মগ-ফিরিঙ্গিদের আবাস্থল। তাদের হামলার প্রতিরোধে মসজিদটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। শাহ সুজা মগ ফিরিঙ্গীদের দমনের জন্য ঝালকাঠির সুজাবাদে এক সেনানিবাস গড়ে তোলেন, যা সুজাবাদ কেল্লা নামে পরিচিত। শাহ নেয়ামতুল্লাহের অলৌকিকতার গুণের কারণে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হন বহু হিন্দু ও বৌদ্ধ। ওই সময় বিষখালী নদীর পানি ছিল লবণাক্ত। সুপেয় পানির অভাবে মানুষের কষ্ট দেখে শাহ নেয়ামতুল্লাহ নিজের তসবিহ নদীতে ভিজিয়ে নেন, এতে পনি সুপেয় হয়। আজও পানি একই অবস্থায় রয়েছে। তাছাড়া সে যুগে সুন্দরবন সংলগ্ন এ নদীতে অসংখ্য কুমির ছিল। তার অলৌকিকতার কারণে কুমির আসত না। এমন অনেক কাহিনী আজও প্রচলিত রয়েছে। তার রেশ ধরে এখনো মনোবাসনা পূরণে প্রতিদিন অগণিত নারী-পুরুষ মসজিদে নামাজ আদায় করেন। টাকা-পয়সা ও অন্যান্য মানতের মালামাল রেখে যান। আরো পড়ুন : বেড়েরধন নদীর সূর্যোদয়ের নৈসর্গিক দৃশ্য মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মিত মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩৩ ফুট ও প্রস্থ ৩৩ ফুট, দেয়াল ৬ ফুট চওড়া। দক্ষিণ ও উত্তরে তিনটি দরজা রয়েছে। মসজিদের ইটগুলোও মোঘল ঐতিহ্যের ছাপ বহন করে, দৈর্ঘ্য ১২ ইঞ্চি ও প্রস্থ ১০ ইঞ্চি। উঁচু টিলার উপর অবস্থিত মসজিদটির উচ্চতা ২৫ ফুট। মসজিদের পাশেই রয়েছে ৩টি কবর, কবরগুলো সাধারণ কবরের মতো হলেও লম্বায় ১৪-১৫ হাত। মসজিদের পশ্চিম ও উত্তর পাশে অবস্থিত কবরে শায়িত আছেন সাধক নেয়ামতুল্লাহ এবং তার দুই মেয়ে চিনিবিবি ও ইছাবিবি। ১৭০০ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে নেয়ামত শাহ মারা যান বলে জানা যায়। মোঘল স্থাপত্যের গৌরব, মর্যাদার ও ইতিহাসের সাক্ষী হিসেবে শুধু দেশেই নয় গ্রেট ব্রিটেনের যাদুঘরেও এ স্থাপত্যটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। যেখানে একে ৫শ’ বছর আগের নিদর্শন হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিবিচিনি শাহী মসজিদটির ধ্বংসাবশেষ দীর্ঘদিন সংস্কারবিহীন ছিল। ২ দশক ধরে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। কয়েক বছর আগে মসজিদ দেখাশুনার জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ মো. আব্দুল হাইকে অস্থায়ী নিয়োগ দেয়। তিনি জানান, ১৯৯৩ সালে মসজিদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও সংস্কারের জন্য প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু সে কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। মসজিদটির সামনের রাস্তাটির অবস্থা একদম বেহাল। বিশুদ্ধ পানি, অজু ও স্বাস্থ্যসম্মত টয়লেটের ব্যবস্থা নেই। একজন কেয়ারটেকার থাকলেও তার কোনো কাজ নেই। রক্ষণাবেক্ষণের অভাব তো রয়েছে, এ ছাড়া মসজিদের টিলার পাদদেশ কেটে জমি বানিয়ে চাষাবাদ করায় ঝুঁকি বেড়েছে। আরো পড়ুন : অল্প সময়ে জনপ্রিয় সোনাকাটা ইকোপার্ক, সংস্কারের অভাবে ভোগান্তিমসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি বেতাগী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মনির হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘দর্শনীয় স্থান হিসেবে অত্যন্ত চমৎকার একটি জায়গা। কিন্তু এর দেখাশুনার জন্য স্থায়ী কেউ না থাকায় সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। মসজিদে যাবার রাস্তাটি সংস্কার ও মসজিদের পাশে একটি ডাকবাংলো নির্মাণ করা হলে দর্শণার্থীরা এসে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।’ আমার মতো অনেক দর্শনার্থী প্রতিদিন বিবিচিনি শাহী মসজিদের সিগ্ধ ও সৌম্যরূপে পবিত্র হতে আসেন। কিন্তু তার সৌন্দর্য দিন দিন ম্লান হচ্ছে। তাই প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিকল্প নেই। শেয়ার করতে আইকনে ক্লিক করুনTweetWhatsAppPrint বিবিচিনি শাহী মসজিদ ২০১৫-০৮-২৭ Barguna Online