বরগুনা অনলাইন : আজ ১৫ নভেম্বর। ২০০৭ সালের এই দিনে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন সিডর। সাইক্লোন সিডরের আঘাতে কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানিসহ মারা যায় অসংখ্য গৃহপালিত পশু ও বন্যপ্রাণী। নষ্ট হয় হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল। দুমড়ে-মুচরে যায় ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ নানা স্থাপনা।
সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে বরগুনা, পটুয়াখালী, বাগেরহাট ও পিরোজপুর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ঝালকাঠি, সাতক্ষীরা, খুলনা, গোপালগঞ্জ, মাদারিপুর, শরিতপুর, বরিশাল ও ভোলা। সরকারি হিসাবে সাইক্লোন সিডরের কারণে ৩ হাজার ৪০৬ জন নিহত হয়, নিখোঁজ হয় ১ হাজার তিনজন, মারাত্মক আহত হয় ৫৫ হাজার।
এর মধ্যে শুধু বরগুনা জেলায় সরকারি হিসাবে ১ হাজার ৩৪৫ জন নিহত হয়। সেই সময় থেকে এ পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে ১৫৬ জন। তবে বে-সরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। আহতের সংখ্যা ২৮ হাজার ৫০ জন। ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১ পরিবারে ঘড়বাড়ি বিধ্বস্ত হয় ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৮৫টি, ২ লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৩ একর জমির ফসলের ক্ষতি হয়। গবাদি পশু মারা যায় ৩০ হাজার ৪৯৯টি। ক্ষতিগ্রস্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১ হাজার ২৩৫টি, ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তা ৪২০ কিলোমিটার। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্য আরো বেশি। আর সেইসব ভয়াবহ স্মৃতি মনে করলে এখনো আতঙ্কে শিউরে ওঠে উপকূলবাসী।
বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার নাম নলটোনা। যেখানে সিডরের এক বছর আগে থেকেই বেড়িবাধ ছিল না। সিডরের সময় সেখানে ২০ ফুটের মতো পানি বৃদ্ধি পায়। ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিনই সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। তখনো এলাকাটি পানির নিচে হাবুডুবু খাচ্ছিল। লাশ দাফনের জন্য কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। লাশগুলো নিয়ে আসা হয় বরগুনা-নিশানবাড়িয়া সড়কের পাশে পশ্চিম গর্জনবুনিয়া গ্রামে। দাফনের কাপড় ছাড়াই ৩৩ জনকে ১৯টি কবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়। জায়গার অভাবে পাঁচটি কবরে তিনজন করে ১৫ জন, চারটি কবরে দুজন করে আটজন ও ১০টি কবরে একজন করে ১০ জনের লাশ দাফন করা হয়।
কবরগুলোকে একটু উঁচু করে রাখা হয়েছে। বরগুনা প্রেসক্লাবের সহযোগিতায় স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সংগ্রাম সম্প্রতি ইট দিয়ে কবরস্থানটি ঘিরে দিয়েছে। সারিবদ্ধ কবর দেখে মানুষ এসে থমকে দাঁড়ায়। কেউ কেউ কান্না চেপে রাখতে পারেন না। সিডরের স্মৃতি হয়ে আছে কবরগুলো। কবরগুলোতে শুয়ে আছে, নলটোনা গ্রামের তাসলিমার বাবা আবদুর রশিদ (৫৫), মা আম্বিয়া খাতুন (৫০), ছেলে আল আমিন (৭), ফোরকানের বাবা দিন আলী (৬৫), হাসি বেগমের মেয়ে শাহিনুর (৪), শাহজাহানের মা তারাভানু (৬০), মেয়ে খাদিজা আক্তার (৩), আনিসের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৩০), ছেলে আবু বকর (৩), রফেজ উদ্দিনের স্ত্রী বিউটি বেগম (৩৫), মাসুমের মা হেলেনা আক্তার (৩০), বাদলের মা লালবরু (৬৭), বাবুলের মেয়ে জাকিয়া আক্তার (৮), আবদুস সত্তারের স্ত্রী সাফিয়া খাতুন (৩০), ছেলে রেজাউল (১২), রেজবুল (৭), মেয়ে সাবিনা (৯), সগির হোসেনের মেয়ে সোনিয়া আক্তার (৩), আবদুর রবের ছেলে হোসেন আলী (১২), মেয়ে ময়না (৭), হোসনেয়ারা (৫), শাশুড়ি মনোয়ারা বেগম (৫০), সরোয়ারের স্ত্রী জাকিয়া আক্তার (৩০), মেয়ে রোজিনা (৪), ছত্তারের স্ত্রী বেগম (৫০), পুত্রবধূ নাজমা আক্তার (৩০), নাতি পারভেজ (৪), নাসির উদ্দিনের স্ত্রী হোসনেয়ারা (২৬) ও গর্জনবুনিয়া গ্রামের গনি বিশ্বাসের ছেলে জাহিদ হোসেন (৫) ও খাদিজা আক্তার (৩০)। বাকি তিনজনের পরিচয় আজো জানা যায়নি।
বরগুনা সদর উপজেলার ১০ নম্বর নলটোনা ইউনিয়নের তুলাতলা গ্রামের বাসিন্দা আ. কুদ্দুছ বলেন, ‘মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এই স্মৃতি ভোলার নয়। সেই ক্ষত এখনো দগ দগ করছে উপকূলের স্বজন হারানো হাজারো পরিবারের মধ্যে।’
একই গ্রামের বাসিন্দা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘সিডরের আঘাতের চিহ্ন এখনো শরীরে বহন করছি। এই স্মৃতি কখনো হারিয়ে যেতে পারে না। এই স্মৃতি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে।’
সিডরে এত মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, ওই সময় আবহাওয়া বিভাগের সতর্কবার্তা যথাযথ ছিল না। আবহাওয়া অফিস ৪ নম্বর সতর্কতা সংকেত থেকে হঠাৎ করে ১০ নম্বর বিপদ সংকেতের কথা ঘোষণা করে। মংলা সমুদ্র বন্দরকে কেন্দ্র করে যে বিপদ সংকেত প্রচার করা হয়েছিল, তা বোঝার উপায় বরগুনার মানুষের ছিল না। রেডক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবকরা ছিল প্রায় নিষ্ক্রিয়। দুই এক জায়গায় তারা মাইকিং করলেও বেশির ভাগ জায়গায়ই কোনো রকম সংকেত প্রচার করা হয়নি। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তথ্য অফিস মাইকিং করলেও তা ছিল শহর এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। যারা ঘূর্নিঝড়ের সংকেত শুনেছেন, তারাও পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাবে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারেননি।
এ বিষয়ে জাগো নারী নামে এনজিওর প্রধান নির্বাহী হোসনেয়ারা হাসি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা সংকেত স্থানীয় ভাষায় বোধগম্য করে প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ঘূর্ণিঝড় কর্মসূচির সেচ্ছাসেবকসহ বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে।
বরগুনার জেলা প্রশাসক মীর জহুরুল ইসলাম বলেন, সরকারের পাশাপাশি এনজিওগুলোকে সহায়তা কার্যক্রমের সঙ্গে মানুষকে দুর্যোগ মোকাবিলায় সক্ষম করে তোলার বিষয়ে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলেই উপকূলীয় এলাকার মানুষ দুর্যোগ প্রতিরোধে আরো সক্ষমতা অর্জন করবে।
এই দিনকে স্মরণ করে বরগুনা প্রেসক্লাব ও শিক্ষা নেটওয়ার্কের উদ্যোগে সিডর স্মৃতিস্তম্ভে শ্রদ্ধা নিবেদন, শোকর্যালি, স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।