মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে বাস্তবে শনাক্ত করেছেন বিজ্ঞানীরা। গত ১১ই ফেব্রুয়ারি মহাকর্ষীয় তরঙ্গসংকেত শনাক্ত করার আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘোষণা দিয়েছেন একটি বিজ্ঞানী দল। আর সেই দলেরই একজন বরগুনার দীপঙ্কর।
দীপঙ্করের বিরল সাফল্যে আনন্দিত উপকূলীয় বরগুনা জেলাবাসী এবং বাংলাদেশ। এ অথৈ আনন্দের কারণ এ দেশের মেধাবী মুখ বরগুনার সন্তান বিজ্ঞানী ড. দীপঙ্কর তালুকদার।
১৯৭৭ সালে দীপঙ্কর তালুকদারের জন্ম। তার বাবা প্রয়াত পরেশ তালুকদার। মা প্রয়াত পারুল রানী তালুকদার। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে দীপঙ্কর ছোট। ১৯৯২ সালে বরগুনা জেলা স্কুল থেকে এসএসসি ও ১৯৯৪ সালে বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে। সেখান থেকে স্নাতকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হন। এরপর যুক্তরাজ্য থেকে পান কমনওয়েলথ বৃত্তি অ্যাডভান্সড ম্যাথমেটিকস। সেখানে উচ্চতর অধ্যয়ন করেছেন ক্যামব্রিজে (২০০৩)। এরপর কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক পান। সাড়া দেন ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটির। ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পড়ার অংশ হিসেবে এক বছর কাটান জার্মানির হ্যানোভারের আলবার্ট আইনস্টাইন ইনস্টিটিউটে। সেখানে তার গবেষণার বিষয় ছিল, আকাশের স্থানীয় অ্যাস্ট্রো ফিজিক্যাল উৎসসমূহ থেকে কিভাবে দীর্ঘকাল মহাকর্ষ তরঙ্গ খোঁজা যায়। সেখান থেকে ফিরে ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। ২০১২ সালে তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পিএইচডি করেন। একই সঙ্গে কলেজ অব সায়েন্সের আউটস্ট্যান্ডিং গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট পুরস্কার পান। পিএইচডিতে দীপঙ্করের গবেষণার বিষয় ছিল, দুটি ব্ল্যাকহোল মিলিত হলে যে অশান্ত ব্ল্যাকহোল তৈরি হয়, সেখান থেকে আসা বৃত্তায়িত মহাকর্ষ তরঙ্গের সংকেত কীভাবে শনাক্ত করা যাবে। ২০০৭ সাল থেকে দীপঙ্কর মহাকর্ষ তরঙ্গ গবেষণা শুরু করেন। লাইগো সায়েন্টিফিক কোলাবরেশনের সদস্য হন ২০০৮ সালে। বর্তমানে তিনি অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইগো সায়েন্টিফিক কোলাবরেশনের হয়ে কাজ করছেন। যখন তিনি প্রথম সেখানে যোগ দেন, ওই কোলাবরেশনে তখন ৪০০ বিজ্ঞানী কাজ করতেন। এখন ১৫টি দেশের হাজারখানেক বিজ্ঞানী এ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত। সেই দলের একমাত্র বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. দীপঙ্কর। তিনি সর্বশেষ বাংলাদেশে এসেছিলেন ২০০৯ সালে। ওই বছরই চট্টগ্রামের মেয়ে শম্পা বিশ্বাসকে বিয়ে করেন। শম্পা বর্তমানে ওয়াশিংটন স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ে পিএইচডি করছেন। ছোটবেলা থেকেই দীপঙ্কর অদম্য মেধাবী আর পড়াশোনায় বরাবরই খুব মনোযোগী ছিলেন। দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা থেকে তিনি মেধা ও যোগ্যতা বলে আসীন হয়েছেন মহাকাশ গবেষণা সংস্থায়। বিশ্ব দরবারে যে কজন বিজ্ঞানী বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম।
দীপঙ্করের বড় ভাই শঙ্কর তালুকদার জানান, আর্থিক অনটনের সংসারে ছোট ভাইকে লেখাপড়া করাতে তিনি নিজেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেননি। তার আক্ষেপ বাবা-মা ছোট ভাইটির সাফল্য দেখে যেতে পারেননি। ছোট ভাইয়ের সাফল্যে গর্বিত শঙ্কর তালুকদারের মুখে খুশির আভা। জানালেন, আমার বাবা পৌরসভা পরিষদে ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। মানুষের সেবা করতে গিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য-পুঁজি সব খুইয়ে একসময় নিঃস্ব হয়ে পড়েন। আর্থিক অনটনের কারণে আমার এসএসসি পরীক্ষা দেয়া হয়নি। তিন বোন ও দুই ভাইসহ সাতজনের সংসার আমাদের। আমি পড়াশোনা করলে ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা হবে না, তাই আর পড়াশোনা করলাম না। নিজের সিদ্ধান্তে পরদিনই কিছু চাল ও আটা মহাজনের কাছ থেকে বাকিতে নিয়ে সাহাপট্টি এলাকার রাস্তার পাশে শুরু করি ব্যবসা। ছোটবেলা থেকেই দীপঙ্করের পড়াশোনায় মনোযোগী আর আগ্রহ দেখে সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবেই হোক তাকে লেখাপড়া করাতে হবে। তাই তাকে প্রথমে শহরের আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করি। এসএসসিতে ভালো ফল করলেও অর্থাভাবে ঢাকার ভালো কলেজে ভর্তি করাতে পারিনি। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাকে বরগুনা সরকারি কলেজে ভর্তি করাতে হয়। এইচএসসির পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তির সুযোগ পায় দীপঙ্কর।
দীপঙ্করের ছোট চাচা অমলকৃষ্ণ বলেন, দীপঙ্করের এ সাফল্যে আমরা সবাই গর্বিত। সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু জানান, দীপঙ্কর শুধু বরগুনা জেলারই সন্তান নয়, তিনি বাংলাদেশের সন্তান। তার এই গৌরবোজ্জ্বল সাফল্যে আমরা বরগুনাবাসী আনন্দিত।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। ৯টা ৫০ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে লাইগোর শনাক্তকারক যন্ত্রে একটি সংকেত আসে। ৩ মিনিটের মধ্যে বিজ্ঞানীরা তা জানতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় ই-মেইল চালাচালি। ঘণ্টা কয়েকের মধ্যেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, এটি পৃথিবীর নিজস্ব কোনো তরঙ্গসংকেত নয়, ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরের দুটি ব্ল্যাকহোলের মিলনের ফলে সৃষ্ট মহাকর্ষ তরঙ্গেরই সংকেত। তাদের লাইগোর শনাক্তকারকে ভূমিকম্প, রেডিও তরঙ্গ থেকে শুরু করে যত ধরনের তরঙ্গ আসতে পারে, সবকিছু শনাক্ত করার আলাদা-আলাদা মিটার বসানো আছে। বিজ্ঞানীরা সবাই উত্তেজিত। এখন তাদের আরও গবেষণা করতে হবে। করতে হবে আরও হিসাব-নিকাশ, যাচাই-বাছাই। তারপর নিশ্চিত হতে হবে যে এই দুটি ব্ল্যাকহোলের মিলিত হওয়া থেকে উদ্ভূত তরঙ্গ। অরিগন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইগোর বিজ্ঞানী দলকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, এ সংকেত পৃথিবীর বা এই সৌরজগতের অন্য কোত্থেকে এসেছে, নাকি এসেছে ব্ল্যাকহোল থেকেই তা বিশ্লেষণ করে দেখার। অন্যদের মতো ড. দীপঙ্কর সেই কাজে ডুবে যান। গোপনে তারা কাজ করেন। একপর্যায়ে নিশ্চিত হন, এটি ব্ল্যাকহোলের মহাকর্ষ তরঙ্গসংকেত। তারপর ১১ই ফেব্রুয়ারি বিজ্ঞানীরা সংবাদ সম্মেলনে জানালেন বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের কথাই সঠিক।
সূত্র : মানবজমিন